যোদ্ধা এক ফাতেমা বেগম
১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রাম নাম বিলচাপরি। গ্রামটা বগুড়া জেলার ধুনট থানার অধীন। গ্রামটার এক পার্শ্বে একটা খাল অন্য পার্শ্বে খালটা গিয়ে মিশেছে বাঙ্গালী নদীতে। সেই খালটার পাশে সারি বদ্ধ ভাবে বসে থাকে তিন জন ছোট ছোট বাচ্চা। তাদের প্রতিদিনের কাজ প্রবল স্রোতে ভেসে যাওয়া সব লাশ উল্টিয়ে দেখা। তাদের হাতে থাকে খড়, উল্টাবার কাড়াল নামে এক ধরনে বাঁশের আংটার মত। তারা কাদের লাশ খোঁজে জানেন? তারা খোঁজে ফাতেমা বেগম নামে এক মহিয়সি নারীর আদরের ধনদের লাশ। মহান মুক্তি যুদ্ধে এই "মা" নিজ হাতে তার সন্তানদের চন্দনের তিলক পরিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে ছিলেন যুদ্ধে।
যুদ্ধের শুরুতে তার বড় ছেলে রাজশাহী আর মেজ ছেলে বগুড়ায় হানাদারদের সাথে যুদ্ধ করেন। মেজ ছেলেকে মা চন্দনের তিলক পড়িয়ে পাঠিয়ে দিতেন যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে আসার জন্য। মেজ ছেলে দুইদিন রক্তাত্ব অবস্থায় বাড়ী আসেন। আমরা ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠি। আশঙ্কা করি মেজ ভাই আহত হয়েছেন। তিনি আমাদের আস্বস্ত করেন ওনার কিছু হয়নি, দুই দিন ওনার দুই পাশের যোদ্ধা গুলি খেয়ে মারা গেছেন। বগুড়ার দামাল ছেলেরা বগুড়া রেললাইনের এক পার্শ্বে মাল গাড়ী দিয়ে ব্যারিগেট দিয়ে, আর অন্য পাশে হানাদাররা প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ করে বাড়ী ফিরতো। ফাতেমা বেগমের মেজ ছেলে সদ্য ইন্টার ভর্তি হয়েছেন, টকবগে এক তরুন। হানাদারদের তার জন্মভূমিতে ঢুকতে না দেওয়ার আপ্রান চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়ে শেষ দিন আর বাড়ী ফিরে আসেন নি। দিন তারিখ আমি ঠিক ঠিক বলতে পারবো না। কারন আমি গল্পের লেখিকা তখন নয় বছরের শিশু। কিন্তু সালটা কোন দিন ভুলবো না। মাথার উপর বোম্বিং হচ্ছে। হাজার মানুষ দিক বিদিক ছুটছে প্রানের ভয়ে। ফাতেমা বেগম নামে মাঝ বয়সী একজন মহিলা ও ছুটছেন অজানা গন্তব্যে। উনি জানেন না কোথায় যাবেন। কিন্তু তাকে ও ছুটতে হচ্ছে তার ছোট ৫ সন্তান কে নিয়ে।
আমি এই গল্পের লেখিকা রোকসানা খানম । যোদ্ধা ফাতেমা বেগমের কন্যা। আমি লিখতে চলেছি আমার মায়ের বীরত্বে গাঁথা ১৯৭১ সালের গল্পের কিছু সংক্ষিপ্ত কাহিনী। আমার মা আমাদের ৫ ভাই বোন নিয়ে ছুটে চলছেন কোথায় যাবেন কিছুই জানেন না। মুক্তি যুদ্ধের শুরু। আমরা প্রান ভয়ে দৌড়িয়ে চলছি। কখনো হেঁটে আবার কখনো দৌড়িয়ে। রাস্তার পার্শ্বে কোন গাছ পেলে কিছু ক্ষণ কিছুটা জিরিয়ে নিচ্ছি। মার কোলে আমার এক অসুস্থ্য ছোট ভাই। মা হাটছেন বিরতী বিহীন ভাবে। মার বা আমাদের কিছু চেনা নেই। গন্তব্যের কোন ঠিকানা নেই। হঠাৎ মার গাবতলীর কথা মনে পরে যায়। যেখানে বাবা কর্মরত আছেন। পথ পাল্টিয়ে আমরা গাবতলীর দিকে ছুটা শুরু করি। বগুড়া থেকে গাবতলী শুনেছি ৭ মাইল দূরে। আমরা হেঁটে দৌড়িয়ে পা ফুলিয়ে রাতের বেলা গাবতলী থানায় বাবার কাছে এসে পৌঁছাই। এখানে আমাদের থাকার কোন জায়গা না থাকায় আমরা বাবার এক বন্ধুর বাসা রামেশ্বরপুর যাই। আমরা এতটাই ক্লান্ত ও ক্ষুধার্থ ছিলাম যে রামেশ্বরপুর কি ভাবে পৌঁছেছি রাতে, গাবতলী থেকে রামেশ্বর পুর কত দূর, রামেশ্বর কিছু খেয়ে ছিলাম কিনা রাতে কিছু মনে করতে পারছি না। আগের দিনের সকল ক্লান্তি কষ্ট ভুলে যাই ভোরের সকালের দৃশ্য দেখে। গ্রাম বাংলার সকালের দৃশ্য জীবনের প্রথম দেখা।কবির কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে সমস্বরে সবাই এক সাথে গেয়ে উঠি।“একি অপরূপ রূপে মা তোমারহেরিনু পল্লী জননী” সত্যি এটা আমাদের সোনার বাংলাই তো। সোনার বাংলার এ রূপ তো আমরা কখনো দেখি নি।যদি ও এত কিছু বোঝার বয়স আমার তখন ও হয় নি। কিন্তু এটা বুঝতে আমার ছোট মনে একটু ও কষ্ট হচ্ছে না আমি এই সোনার বাংলার একজন বাসিন্দা আর এই বাংলা , আমি কোন অপশক্তির অধীনে দিব না। রামেশ্বপুরের প্রথম সকালটা আমাদের অনেক উপভোগ্য ছিল। না ছিল বই না ছিল খাতা। শুধু আনন্দ আর আনন্দ। আগের দিনের সব কষ্টগুলো প্রকৃতির এই রুপ দেখে সব ভূলে গেছি। মাঠের পর মাঠ সহজে ভরা। ঠিক মনে করতে পারছি না কি ফসল ছিল। তবে আলু গাছ হওয়ার সম্ভবনা বেশী কারন মনে পরছে আলু শাক ভাজি দিয়ে সকালের ভাতটা খেয়ে ছিলাম। সে স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।আমাদের সাথে ছিল বরিশাল থেকে আগত ইন্টার পড়ুয়া একজন খালাতো বোন। সে বেশ সুন্দরী ছিল। তাছাড়া আমার ইমিডিয়েট ১১ বছর বয়সী বড় বোনটাও সুন্দরীদের খাতায় নাম লেখাচ্ছিলেন। দুই, এক দিন কাকার বাসায় ভালই কাটলো আমাদের। এর পর শুরু হলো দুর্যোগ। কাকী চাল, ভাল, তেল, নুন সব লুকাতে শুরু করে দেন। একটু পর পর চিৎকার আর্মি আসছে! আমার বোনদের গালি দিয়ে বলা শুরু করেন, মুখে কালি মাখ ছেঁড়া কাপড় পর ইত্যাদি অনেক কিছু। গর্তের ( বাঙ্কার) মধ্যে লুকা। ওনার এ সব বলা স্বাভাবিক ই ছিল। কারন নিজেদের জীবন বাঁচানো যেখানে অসম্ভব সেখানে আমরা গোদের উপর বিষ ফোড়া। মা কি করবে কোথায় যাবে কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। কারন সময় খুব দ্রুত গতিতে পাল্টে চলছে। ইতি মধ্যে বড় দাদা ( বড় ভাই) রাজশাহী থেকে কোন ভাবে আমাদের খোঁজ পেয়ে আমাদের কাছে চলে আসেন। তিনি বুঝতে পারেন এখানে আমাদের আর থাকা সম্ভব নয়। তিনি গাবতলীর গোরদহ নামক স্থানে বেড়া দিয়ে তৈরীর এক রুমের একটা বাসা ভাড়া নেন। আমরা সেখানে চলে আসি। ঘরটার সাথেই লাগানো একটা চিকন করিডোর + বাহিরে বের হওয়ার রাস্তা। বড় দাদা ঐ করিডোরে বসে দেখতাম তাস খেলায় মগ্ন থাকতেন। একদিন মা এসে দাদাকে চড় থাপ্পর মারছেন আর বলছেন তুই তাস খেলছিস, আমার নান্টুকে না হানাদার ধরে নিয়ে গেছে। দাদা ও হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বলেন আমি সকালেই জানি মা। পরে শুনেছি এটা বড় দাদাদের অপারেশনের একটা অংশ ছিল।মা সেদিন হাঁসের মাংশ রেঁধে ছিলেন। নান্টু আমার সেজ ভাই। সে মাকে বলেন আমি এখনি আসছি বলে বাহিরে বের হন। সারা দিনে ভাই যখন আসেন নি, মা চুপি চুপি আশে পাশের বাড়ী গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, বগুড়ার শাপ গ্রাম নামক স্থানে মুক্তিরা মাইন বাষ্ট করে একটা ব্রিজ উড়িয়ে ফেলেছে। সেই অপারেশনে সেজ ভাই ছিলেন ১৩ বছরের ক্ষুদে মুক্তি। আমরা সবাই কাদেছি অনেক কিন্তু চুপি চুপি যাতে করে কেউ কিছু শুনতে না পারে।আমাদের বাড়ীর চারদিকে সবাই প্রায় মুক্তি দু একটা ঘর রাজাকার বাদে। বড় দাদা রাতের বেলায় অন্য মুক্তিদের নিয়ে অপারেশনে বের হতেন সেটা কখনোই জানা হতো না যদি দু দিন পর আমাদের বাসায় দাদার খোজে এক দল হানাদার বঙ্গালী পুলিশ আর রাজাকার না আসতো। সকাল ১০টায় আহত এক রাজাকার হানাদারদের কাধে ভর করে মুক্তিকে ধরতে নিয়ে আসে। সেই মুক্তি ছিল আমার দাদা। দাদা রাতের বেলা অপারেশনে বের হয়ে এক রাজাকারকে তিন জন মিলে পাটের ক্ষেতের মধ্যে নিয়ে যায় এবং অন্ধকারে গুলি করে। গুলি ঠিক মত না লেগে রাজাকারের পা ঘেসে বের হয়ে যায়। রাজাকার না মরে সামান্য আহত হয় তার ফলস্বরুপ হানাদারদের নিয়ে আসে। হানাদাররা মাকে অনেক রকম জেরা করতে থাকে এবং ছেলেকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বলে না হয় কোলের বাচ্চাটা পর্যন্ত আছরিয়ে মেরে ফেলবে। ওরা আমার বাবাকে যাওয়ার সময় ধরে নিয়ে য়ায়। বাবা যাওয়ার সময় তার হাতের ঘড়িটা একটু এগিয়ে এসে খুলে দিয়ে যান , তখন আমাদের কান্না দেখে মনে হয় আকাশ বাতাস সব কেদে ছিল। বাবাকে নিয়ে যাওয়ার সময় মাকে বার বার হুসিয়ারী দিয়ে যায় কাল আবার আসবো ছেলেকে ধরিয়ে দিবেন। না হয় সবাইকে ধরে নিয়ে যাব। দাদা তার সহ যোদ্ধার বোনের বাড়ী ধুনট আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ধুনট যেতে হলে আমাদের বিলের মধ্যে দিয়ে নৌকায় করে যেতে হবে। সকালে নৌকা এসে পারে থামে। আমি আর দাদা আমাদের যে টুকু মালামাল ছিল সেটা নৌকায় তুল ছিলাম। রাস্থাটা ছিল বিলের থেকে অনেক উঁচু। দ্বিতীয় বার মাল নৌকায় তুলে রাস্থায় উঠা মাত্র আগের দিনের হানাদারদের দল রাস্তার পশ্চিম থেকে পূ্র্ব দিকে আমাদের বাড়ীর দিকে যাচ্ছে। আমি আর দাদা তাদের দেখে কিংকর্তব্য বিমূঢ। নীচ থেকে তাদের দেখা যায় নি। উপরে উঠা মাত্র ওদের মুখামুখি আমরা। আমি ওদের চিনে ফেলেছি। ওরা আগের দিন বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। ওদের সামনেই আমার দাদা। আমি কিছু ক্ষনের জন্য বেঁচে ছিলাম না মরে গিয়ে ছিলাম মনে নেই। দাদা নিরবে আমাকে রাস্থার এক পার্শ্বে রেখে অন্য পাশ্বে হিসু করার অভিনয় করে বসে পরেন। পরে বুঝেছি দাদার অন্য পার্শ্বে যাওয়ার কারন। দাদা বুঝতে পেরেছে দাদাকে ধরার জনা ওরা এসেছে। দাদা আমার সাথে থাকলে ওরা যদি দাদাকে চিনে ফেলে গুলি করে সাথে আমি ও মারা যাব। পালাবার কোনো পথ ছিল না। পালাবার চেষ্টা করলেই ওরা বুঝে যাবে। তাই দাদা নিশ্চিত মৃত্যু জেনে ও কিছুটা কৌশল অবলম্বন করেন। বিধাতা আমাদের সহায় ছিলেন তাই ওরা আমার দাদাকে না চিনে দাদার পাশ কাটিয়ে আমাদের বাড়ী যায়। ওরা সামনের দিকে এগুলে দাদা আস্তে করে পাট ক্ষতের মধ্যে নেমে যায় আর আমি কিছুটা দুরত্ব রেখে ওদের পিছু আমাদের বাড়ী যাই। ওরা আমার মাকে তার ছেলেকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য নানা ভাবে বলতে থাকে। মা ভাল উর্দু বলতে পারতেন তাই তিনি ও ওদের সাথে বিভিন্ন কলা কৌশল করতে থাকেন। ছেলে আসলেই মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিব তোমাদের খবর দিতে।
রাজাকাররা অনেক লাফালাফি করে ঘরের ভিতর একটু ঢুকে দেখার জন্য। ওরা ঘরের ভিতর ঢুকতে পারলেই আমার বোনদের দেখে ফেলতো। তখন কি হতো সেটা মনে হলেই আজ ও বুকের ভিতর কেঁপে উঠে।হানাদার চলে যায় আবার আসবে বলে। আমরা সবাই বের হয়ে নৌকায় উঠে পরি। দাদা পাট ক্ষেত থেকে বের হয়ে আমাদের বিদায় দেন। আমাদের নৌকা ছেড়ে দেয়। যত দুর দেখা যায় দাদাকে আমরা তাকিয়ে দেখি। আমার মা বুকে পাথর বেঁধে এখানে ফেলে গেলেন তার স্বামী আর আদরের দুই ছেলেকে। মা সাথে নিতে ভুলেন নি তার আদরের ছেলের জন্য রান্না করা হাঁসের মাংসের কিছু অংশ। মার বিস্বাস তার ছেলেরা আসবেই ।বিলের মধ্যে দিয়ে চলছে আমাদের নৌকা। আমরা যে দিন বগুড়া থেকে পালিয়ে এসে ছিলাম ঐ দিন মা বাড়ীর যত গুলো মুরগী ছিল সব রেঁধে ছিলেন সাথে ছিল পোলাও। কিন্তু আমরা কিছু খেতে পারিনি। সব ফেলে খালি হাত পা নিয়ে পালাতে হয়ে ছিল। আজ ও একই অবস্থা। আমরা তো সবাই প্রায় ছোট। একটু পর আমাদের ক্ষিদে পায়। বিলের মধ্যে অনেক ধরনের লতানো গাছ । যে গুলো কোন দিন দেখি নি। আমাদের মাঝি বুঝতে পারে আমরা অনেক ক্ষুধার্থ। উনি আমাদের বলেন এগুলো পানি ফলের গাছ। তোমরা ইচ্ছে করলে খেতে পার। আমরা ক্ষুধার্থ পেটে পানি ফল তুলে খেতে শুরু করি। আমাদের নৌকা সন্ধ্যর কিছু পর বিলচাপরী এসে পৌঁছায়। রাতে কি খেয়ে ছিলাম মনে নেই। জুলূসা নামে এক ব্যক্তি তাদের একটা ঘরে আমাদের থাকতে দেন। ঐ বাড়ী সম্ভবত সাত দিন ছিলাম। পরে বকুল নামে আর একজন তাদের ঘর আমাদের ছেড়ে দেন থাকার জন্য। গ্রামের মানুষের এত বেশী ঘর থাকে না। তাদের থাকার ঘর আমাদের দিয়ে তারা মা, ছেলে একটা ছাপড়ায় গিয়ে থাকতো।আমরা ওখানে যাবার পর গ্রামের সব যুবকরা ভারত চলে যায় প্রশিক্ষন দিতে। দুই চার জন রাজাকার বাদে গ্রামটা একদম পুরুষ শূন্য হয়ে যায়।আমাদের থাকার জায়গা হলো কিন্তূ খাবার দিতে মা হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন। আমার মা ছিলেন বরিশাল জেলার বানারী পাড়া গ্রামের আব্দর গফ্ফার সাহেবের রাজ কুমারী। সেই রাজকুমারীকে আমার বাবা রানী বানিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এনে ছিলেন তার বাড়ীতে। এই কথাটা অপ্রসঙ্গিক তবু ও লেখার কারন , সেই রানী আমাদের খাবার জোগাতে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে ধান কিনে নেন। সেই ধান নিজেই সিদ্ধ করে নিজেই ঢেকিতে পার দিয়ে চাল বানান। কতটা দক্ষতার থাকলে একজন শহুরে মানুষ এই কাজ গুলি করতে পারেন। জনি ইচ্ছা করলে চাল কিনতে পারতেন। এখানে তিনি তার দূরদর্শি চিন্তার পরিচয় দিয়েছেন। কারন যুদ্ধ কখন শেষ হবে জানা নেই। বাচ্চাদের মূখে এক মুঠো খাবার দিতে হবে তো মাকে। হাটুরেদের সাথে ৫ টাকা নিয়ে অনেক দুর হেঁটে হাটে যেতাম আমি। তখন আমাদের পরিবারের এক মাত্র কর্তা ব্যাক্তি আমি। সারা দিন বরর্শি হাতে খালে , ডোবায় ঘুরে যে দু, একটি মাছ ধরে বেড়াতাম সেটাই আমাদের আমিষের চাহিদা মেটানো। সমস্য একটা দেখা দেয় ছোট একটা ভাই কিছুতেই মাছ ,মাংশ ছাড়া ভাত খেতে চাইতো না। তাই আমাকে সারা দিন থাকতে হতো বরশি হাতে। আগুন যেমন ছাই দিয়ে চাপা দেওয়া যায় না তেমনি আমাদের পরিচয় ও বেশী দিন লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। রাজাকাররা জেনে যায় আমার মা মুক্তিদের মা। একদিন এক রাজাকার একদল হানাদার নিয়ে হাজির আমাদের গ্রামে। গ্রামের মধ্যে হানাদার ঢোকা মাত্র খবর হয়ে যেত হানাদার আসছে। যেদিক দিয়ে হানাদার ঢুকতো গ্রামের লোক তার উল্টা দিকে সব দৌড় দিতে। গ্রামের লোকেদের সাথে আমরা সবাই দৌড় দিতাম। আমার ছোট বোন আমাদের সাথে খবর শোনার জন্য একটা রেডিও নেয়া হয়েছিল সেটা বগলে করে দৌড় দিতো।
ওর ধারনা ছিল রেডিও হারালে খবর শোনা যাবে না। খবর শুনতে না পারলে বাবা, ভাইদের কোন খবর পাওয়া যাবে না। আমি ছোট একটা ভাই কোলে নিয়ে ওদের পৌছিয়ে দিয়ে, খাল সাঁতরিয়ে ফিরে আসি আমার মার কাছে। এসে দেখি হানাদাররা মার সাথে কথা বলছে। রাজাকার বার বার বুঝাতে চেষ্টা করছে এটা মুক্তির মা। মা উর্দূ ভাল বলতে পারায় ওদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন ওনার দুই ছেলে পাকিস্থান আর্মিতে আছেন। বেঁচে আছেন না মরে গেছেন মা কিছু জানেন না। হানাদাররা মাকে সান্তনা দেন মাতাজী আপকা লেরকা হামরা মুলকমে আচ্ছা হায় কুছ দিন বাদ চলা আয় গা। আপ মাত রইয়ে। তারা মাকে সান্তনা দিয়ে সে দিনের মত চলে যায়। পালিয়ে গিয়ে সেখানে আরো অনেক বিরম্বনায় পরতে হয়েছে ছোট ভাইটা নিয়ে। সে ক্ষিদে পেলেই অনেক কান্না করতো।ভারত প্রশিক্ষন শেষে মুক্তি যোদ্ধারা দেশে এলে চোরা, গুপ্তা হামলা শুরু করে দেয়। বিলচাপরীর যোদ্ধারা পাশের গ্রামের এক রাজাকারের উপর হামলা চালায়। দুই যোদ্ধা রাজাকারের দুই হাত ধরে ছিল আর এক জন গুলি করে। গ্রামের রাত অন্ধকার থাকায় গুলি রাজাকারের গায়ে না লেগে একটা গুলি এক মুক্তির পেটে ঢুকে যায় আর একটা মুক্তির একটা আঙ্গুল ছিড়ে চলে যায়। রাতের অন্ধকারে কয়েক জন মুক্তি একটা তক্তায় শুয়িয়ে এক জন মুক্তিকে আর একজনকে ধরে নিয়ে আসে আমার মা কাছে। যার পেটে গুলি লেগেছিল সে বেশী চিৎকার করছিল না। যার আঙ্গুল ছিড়ে গিয়েছিল সে খুব চিৎকার করে কাঁদছিল।
গাবতলী হাসপাতাল থেকে আনা গজ ,ব্যান্ডেজ,তুলা দিয়ে মা প্রাথমিক চিকিৎসাটা এখানে দিয়ে দেন। হালকা মনে পরছে কম্বাইন্ড নামে কোন ইনজেকশন দিয়েছিলেন মা টিটেনাস না হওয আহতরা যাবার সময় মার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে অনেক কান্না করে বলে যায় মা দোয়া করেন আমরা যেন সুস্থ্য হয়ে দেশে ফিরে আসতে পারি। সম্ভবত চিকিৎসার জন্য তাদের ভারত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আজ ও জানতে পারিনি তারা সুস্থ্য হয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে আসতে পেরে ছিল কিনা।পরের দিন রাজাকাররা আবার হানাদারদের নিয়ে আসে গ্রামে। আবার মাকে দেখিয়ে বলতে থাকে স্যার এটা মুক্তির মা। এর দু ছেলে মুক্তি। মা যথারিতি মিথ্যা কথা বলেন। তার ছেলেরা পাকিস্তান আর্মিতে আছেন। হানাদার বলে আপনি যে ঘরে থাকেন সে ঘরে যান। আমরা বাকি সব ঘর পুড়িয়ে দিব। মা বলেন আমার নিজের কোন ঘর নেই, আমি আজ এক ঘর পরের দিন অন্য কার ঘরে থাকি। এগুলো সব আমার ঘর। রাজাকাররা অনেক লাফালাফি করে এগুলো সব মুক্তি দের বাড়ী। এরাই মারতে চেয়েছিল আমাদের সাথীদের। অবশেষে ওরা মার সাথে পেরে উঠেনি। হানাদার ওখান থেকে বের হয়ে পাশের গ্রামে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং একজন ছেলে মানুষকে সামনে পেয়ে গুলি করে মেরে ফেলে। হানাদার চলে গেছে ভেবে আমার ছোট বোন বাড়ী ফিরে আসতে ধরলে রাজাকারদের সামনে পরে যায় ওরা বোনের হাত থেকে রেডিও কেড়ে নেয়। বোন দৌড়িয়ে এসে বলে মা ওরা আমার রেডিও কেড়ে নিয়েছে। মা বলেন যা ওদের ডেকে নিয়ে আয়। আমরা দু বোন আবার দৌড় ওদের কাছে। মা ডাকছে বলে ওদের জানাই। ওরা আমাদের কথা মত মার কাছে আবার আসে। মাকে বলে মাতাজী আমাদের ডেকেছেন। মা বলেন হ্যা তোমরা আমার রেডিও নিয়েছ। হানাদার রাজাকারকে বলে এই কে মাতাজীর রেডিও নিয়েছ দিয়ে দাও। রাজাকার উচ্চ স্বরে বলে এটা মুক্তির রেডিও এটা দেব না। মা রাজাকারকে বলে এই রাজাকারের বাচ্চা ওর গায়ে কি লেখা আছে মুক্তির রেডিও। এক থাপ্পর মেরে তোর কান ফাটিয়ে দিব। রাজাকার অনেক চিল্লাচিল্লি করে কোন লাভ করতে না পেরে রেডিওটা দিয়ে দেয়। প্রশিক্ষন শেষে একে একে সব যোদ্ধা দেশে ফিরে যুদ্ধ শুরু করে। অনেকে মাকে দেখে বালাবলি করে ওনার স্বামী ,ছেলেরা কেউ বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে অবশ্যই আসতো। মা মাথা উঁচু করে বলেন আমর স্বামী ,সন্তান বেঁচে আছে তারা দেশ স্বাধীন করে ফিরে আসবেই। তোমরা কেউ বাজে কথা বলবে না।সাহসী মা জানেন না, তার তিন ছেলে আর স্বামী কোথায় কি ভাবে আছে । বেঁচে আছে না শহীদ হয়েছে।
তারপর দৃড় বিস্বাসে পথ চেয়ে আছেন। এই গ্রামে থেকে ওনি বিভিন্ন ভাবে দেশ রক্ষার কাজে কাজ করেছেন। দিয়েছেন গ্রামের মেয়েদের কিছু যুদ্ধ করার এবং আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ। এমনি অনেক ঘটনা আছে ওনার জীবনে। যেটা ছোট পরিসরে লেখা সম্ভব না।আমার সেই দিন গুলির কথা বা স্মৃতিগুলো বার বার বলতে বা লিখতে ইচ্ছা করে।কারন আমি চিরদিন পৃথিবীতে থাকবো না। এই কথা গুলো বলার বা লেখার আর কেউ থাকবে না। আমি কি করে ভুলি ১৯৭১ সালের আমার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সেই বিভিষিকাময় দিন গুলির কথা। এই দেশ স্বাধীনের পিছনে হাজার বাংঙ্গালীর সাথে আমাদের পুরা পরিবারের অবদান এবং আমার মায়ের সাহসিকতার কথা।তার দুই ছেলে মুক্তি যোদ্ধা যথা ক্রমে; মৃত আবু মোঃ ফিরোজ, মুক্তিযোদ্ধা গেজেট নাম্বারঃ 1165 _ 01100005656 লতিফপুর উত্তর পাড়া বগুড়া। পিতাঃ মৃতঃ এ বি এম এ গনি বেসামরিক গেজেট (2783) ভারতীয় তালিকা (43828), লাল মুক্তি বার্তা (306010278)২ য় ছেলে মৃত আবু মোঃ ফারুক ঠিকানা একই মুক্তিযোদ্ধা গেজেট নাম্বারঃ 1166. _ 01100005657 বেসামরিক গেজেট (94) ভারতীয় তালিকা (43807) লাল মুক্তি বার্তা (306010316) । পাতলা, লকলকে গড়নের ১৫/১৬ বছরের এক তরুন ট্রেনিং শেষে ফিরে এসে যুদ্ধে যোগ দেয়। তার যুদ্ধ ক্ষেত্র ছিল সম্ভবত বগুডা, সারিয়াকান্দি, রংপুর, গাইবান্দা। আমার বড় ভাই আমাদের বিলচাপরী পাঠিয়ে ভারত চলে যান। সেখানে জুনিয়র ইনেস্টেক্টর হিসাবে কাজ করেন। পরে দেশে এসে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও এই সব এলাকায় সম্ভবত যুদ্ধ করেন।মেজ ভাই কোন যোদ্ধার মাধ্যমে জানতে পারেন আমরা বিলচাপরী আছি। হঠাৎ একদিন খবর ছড়িয়ে পরে মেজ ভাই আসছে। আমি শুনে দৌড় দেই রাস্তা দিয়ে। অনেক দুর যাওয়ার পর কোথায় তাকে না দেখে ফিরে আসি বাসায়। এসেই দেখি মেজ দাদু বের হয়ে যাচ্ছে। সে নৌ পথে এসেছিলেন। গায়ে ছিল পীত কালারের একটা হাওয়াই সার্ট আর হাঁটু পর্যন্ত পরা একটা লুঙ্গি। হাতে গামছায় মোড়ানো দুই বা তিনটা গ্রেনেট সাথে আর একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি এসে দেখি দাদু যে পথে এসে ছিলেন সেই পথেই ফিরে যাচ্ছেন। দাদুর মুখে কোন কথা নেই । মুখটা ভয়ে বিবর্ন। কারন দাদু আসা মাত্র এলাকার মানুষ এক নজর তাকে দেখার জন্য ভির করে ফেলেছে। সবাই শুনেছেন আমার ভাইদের নাম কিন্তু দেখেনি কেউ একবারের জন্য। এই ভাবে ভির বারতে থাকলে কথাটা রাজাকারের কান পর্যন্ত পৌঁছাবে আর পরিনতি কি হবে ভেবে দাদু আমাদের করো সাথে একটা কথা না বলে দ্রুত নৌকায় গিয়ে উঠে। আমি পিছন পিছন দৌড়িয়ে যাই । নদীর পারে দাঁড়িয়ে দাদুকে যত দুর দেখা যায় তাকিয়ে থাকি। নৌকা দূরে মিলিয়ে যায়। আমি অনেক ক্ষন চিৎকার করে ওখানেই কাদি। তারপর বাড়ী ফিরে আসি। আমি যত দিন বেঁচে থাকবো দাদুর সেই ভয়ার্ত মুখের স্মৃতিটা কোন দিন ভূলতে পারবো না। পাকিস্তানি বাহিনী সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করলে আমার সেজ ভাইটা ছাড়া পায়। আমার মায়ের রেখে দেওয়া হাঁসের মাংশ তার সেজ ছেলের জন্য রাখা তখন ও রয়ে গেছে। ছেলে ফিরে আসবে সেই আশায় সংরক্ষনের জন্য প্রতিদিন মাংশটা গরম করে রাখতেন। তার সেই আশা বিফলে যায়নি। আমি আমার মেজ বোন খাল পারে বসে আছি হাতে কাড়াল নিয়ে। দুরে নৌকায় কে একজন আসছে। বোন চিৎকার করে বলে রিংকু দেখ নৌকায় নান্টু দাদুর মত কেউ। নান্টু দাদু আমাদের দেখতে পায়। সে চিৎকার করে বলে খুকু আমি তোদের নান্টু দাদু। আমরা দু বোন খুশীর কান্নায় ভেঙ্গে পরি। মার কাছে দৌড়িয়ে যাই একজন সংবাদটা দিতে। মার হাড়ানো ছেলের একজন ফিরে এসেছে। যুদ্ধ শেষের দিকে। বর্ষা কাল। পানি থৈ থৈ। অসংখ্য লাশ ভেসে যাচ্ছে নদী, খাল দিয়ে। আমারা হাতে কাড়াল নিয়ে বসে থাকি লাস উল্টিয়ে দেখার জন্য। অনেকে ফিরে এসেছে গ্রামে। আসেনি শুধু আমাদের কেউ। একটা, দুইটা , তিনটা, চারটা লাশ এক সাথে ভেসে যাচ্ছে। আমাদের কাজ উল্টিয়ে, পাল্টিয়ে দেখা আমাদের কেউ এর মধ্যে আছে কিনা। একদিন চারটা লাসের মধ্যে পীত কালারের সার্ট পরা একজন দেখতে পাই যার সাথে মেজ ভাইয়ের কিছুটা মিল আছে। আমরা সারী বদ্ধভাবে লাস উল্টিয়ে দেখি। কারন পানির অনেক স্রোত। একজন মিস করলে দ্বিতীয় জন যেন না করে। তাই প্রথম জন দেখে চিৎকার করে পরের জনকে বলে। তার কথামত সবাই উল্টিয়ে,পাল্টিয়ে দেখে আসস্ত হই না এরা কেউ আমাদের ভাই নয়। বাবাকে হানাদাররা বগুড়া পুলিশ লাইন ক্যাম্পে আটকিয়ে রেখেছিল। বিহারীরা বাবাকে চোখ বেঁধে মারার জন্য নিয়ে যায়। ভাগ্য প্রশন্ন ছিল বলে বার বার পাকিস্তানি হানাদার দেখে ফেলায় ওরা বাবাকে ছেড়ে দেয়। বাবাকে ওরা জিজ্ঞাসা করেছিল আপকা লেরকা সাচমুস মুক্তি হায়।
বাবা বলেছিলেন আজ কার ছেলেরা বাবা মার কথা শুনে না। আমার ছেলেরা কোথায় কি করে আমি বলতে পারি না। বিহারিরা অনেক কসরত করে বাবাকে মুক্তির বাবা বানানোর জন্য। তারা তেমন লাভ করতে না পারায় বাবাকে না মেরে আবার ব্যারাকে নিয়ে যায়। বাবা বন্দি অবস্থায় কোন মাধ্যেমে জানতে পারেন আমাদের অবস্থান। একদিন বগুড়া পুলিশ লাইন মসজিদের ইমাম আমাদের দেখতে বিলচাপরি আসেন। আমরা অনেক ভয় পাই ওনি যদি আমাদের অবস্থা বলে দেন। উনি বাবার সব খবর আমাদের দেন। আমরা তখনি জানতে পারি বাবা বেঁচে আছেন। ওনার কাছ থেকে খবর পেয়ে হঠাৎ একদিন বাবা এসে হাজির। আমাদের খুশির সীমা নেই । সেজ দাদু , বাবা ফিরে এসেছেন। কিন্তূ বাবা আবার ফিরে যেতে চাইছেন। তিনি হানাদারদের কথা দিয়ে এসেছেন পরিবারের খোঁজ করে সাত দিনের মধ্যে আবার চলে আসবো। বাবা বার বার বলছিলেন আমি না গেলে ওরা আমার খোজে আসবে এবং সবাইকে মেরে ফেলবে। মা কোন ভাবেই বাবাকে আর যেতে দিবেন না। মরতে হলে এক সাথে সবাই মরবো। তাছাড়া আমাদের দামাল ছেলেরা বিভিন্ন জায়গা দখল করে নিচ্ছে। দেশ স্বাধীন হতে আর বেশী দিন বাকি নেই। বাবাকে আমরা আর কোন ভাবে যেতে দেই নি। বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসতে শুরু হয় দেশ স্বাধীনের।অতপর সেই মহেন্দ্র ক্ষনের সংবাদ আসে আমরা স্বাধীন হয়েছি। ১৬ই ডিসেম্বর আমদের দামাল ছেলেরা বাঁশ, কাঠ, খুন্তি, সাবল দেশীয় অস্ত্র সাথে প্রচন্ড মন বল নিয়ে বিশ্বের বুকে লাল সবুজের পতাকায় বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ নামে নতুন একটা দেশের জন্ম দেয়। আমি আমরা সে দেশের নাগরিক। সবাই ফিরে আসলেও আমার ভাইরা এখনো আসছে না । চলছে আমাদের অপেক্ষার পালা। বড় দাদা সম্ভবত ঠাকুরগাঁও ছিলেন। তিনি কার মুখে শুনেছেন আমারা বেঁচে আছি কিন্তু মেজ দাদুর খবর তিনি পাচ্ছিলেন না। ছোট ভাই ছাড়া মার কাছে কোন মুখে আসবে তাই তিনি ছোট ভাইয়ের খোজে ছিলেন। যখন জানতে পারেন ভাই বেঁচে আছে এবং সে ইন্ডিয়ান আর্মিদের সাথে বগুড়ায় আসছেন। মেজ ভাই পরের দিকে ইন্ডিয়ান আর্মিদের সাথে ট্যাঙ্কে করে বগুড়া প্রবেশ করে ছিলেন। বড় দাদা বগুড়া এসে মেজ দাদুকে খুঁজে বের করে এক সাথে মায়ের কাছে ছুটে আসেন। অনেক কষ্ট অনেক প্রতিক্ষার পর মা তার আদরের সন্তানদের দুধ দিয়ে ধুয়ে বুকে টেনে নেন। গল্পটা লিখতে গিয়ে আমি ১৯৭১ সালে চলে গিয়েছিল। বার বার কান্না আমার দু চোখ ঝাপসা করে দিচ্ছিল। যারা না দেখেছে এই যুদ্ধ তারা কোন দিন বুঝতে পারবে না কত কষ্টে অর্জিত আমাদের এই সোনার বাংলা। আমি শুধু আমার মায়ের ছোট ছোট কিছু ত্যাগ, দুঃখ, কষ্ট, বিচক্ষনতার কথা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমি আমার মায়ের সাথে আজাদের মা, রমা চৌধুরী আরো নাম না জানা হাজার মাকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম এবং শ্রদ্ধা। আবদুল গফফার তালুকদারের রাজকুমারীকে আমার বাবা রানি করে এনেছিলেন তার রাজ্যে, পরবর্তিতে তার সন্তানরা তার মাথায় মহারানীর মুকুট পরিয়ে মহারানী বানিয়ে ছিলেন। আমাদের সেই মহারানী তার রাজ্যের উঠানে শুয়ে আছেন তার প্রান প্রিয় বীর মক্তি যোদ্ধা বড় এবং মেজ ছেলেকে বুকে নিয়ে। আমার অনুরোধ সবার কাছে কেউ জোরে কথা বলে তাদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিবেন না। এই ক্ষদ্র পরিসরে আমার পক্ষে আমাদের মুক্তি যুদ্ধের কাহিনী সব লেখা সম্ভব নয়। তাই এখানেই শেষ করছি। আমি চাই এ দেশের এই মহান ব্যাক্তিদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্নাক্ষরে লেখা থাক। যেটা কোন দিন কোন অপশক্তি মুছে ফেলতে পারবে না।
(লেখাটি উৎসর্গ আমার মা ফাতেমা বেগম কে)
ডিএসএস/