মনোমুগ্ধকর কুসুম্বা মসজিদের অন্দর
সুন্দর স্থাপত্যশৈলীর জন্য কুসুম্বা মসজিদটি এখন নওগাঁর প্রধান পর্যটন আকর্ষণও বটে। বছরজুড়ে ভিড় থাকে পর্যটকদের। এটি নওগাঁর একমাত্র মসজিদ যেখানে অমুসলিমরাও ঘুরতে যেতে পারেন। কালো ও ধূসর রঙের পাথর আর পোড়ামাটির ইটে গড়া মসজিদ। অসাধারণ কারুকার্য খচিত মনোমুগ্ধকর কুসুম্বা মসজিদের অন্দর যে কাউকে নিমগ্ন করে তুলবে।
মসজিদের অন্দর পশ্চিম দেয়ালে ফুল ও লতাপাতার অলংকরণ সমৃদ্ধ ৩টি মিহরাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি কালো পাথরের প্যানেল দ্বারা আবৃত এবং অত্যন্ত কারুকার্য খচিত ঝুলন্ত শিকল, ফুল ও লতাপাতার নকশা অলংকৃত রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরে উত্তর- পশ্চিম কোণে উত্তরের মিহরাবের সঙ্গে সমন্বয় করে নকশা করা ৪টি কালো পাথরের পিলার দ্বারা খিলানাকৃতির দরজা এবং এর উপর তৈরি করা হয়েছিল একটি আয়াতাকৃতির মঞ্চ বা ‘বাদশাহ-কি-তাখ্ত' যা 'জেনানা গ্যালারি’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের ৫ টাকার নোটে কুসুম্বা মসজিদের ছবি ছাপানো আছে।
নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়নের কুসুম্বা গ্রামে বর্তমান কুসুম্বা মসজিদটির অবস্থান। মসজিদটি ২৪.৭৫২৭৫৯ অক্ষাংশ এবং ৮৮.৬৮১৪৫৭ দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ১৭.৫৭মি. × পূর্ব- পশ্চিমে ১২.৭২মি এবং দেয়ালসমূহ প্রায় ১.৮১ মিটার প্রশস্ত। মসজিদের দেয়ালসমূহ বাইরে ও ভেতরে কালো পাথর দ্বারা আবৃত। মসজিদটিতে ৩টি করে দুই সারিতে মোট ৬টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটির বাইরে এবং ভেতরে কালো পাথরের উপর খোদাই করা অলংকরণ এবং চার কোণে চারটি অলংকৃত অষ্টকোণাকৃতি বুরুজ রয়েছে। পূর্ব দেয়ালে তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশ পথ এবং উত্তর ও দক্ষিণে দুটি করে খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে।
আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে এই স্থানে বসে কাজী (বিচারক) বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। এই মঞ্চে উঠার জন্য উত্তর পার্শ্বে পাথরের তৈরি একটি সিঁড়ি পথ রয়েছে। বহু গম্বুজ, ধনুকবক্র কার্নিশ, গম্বুজ, ছাদ পর্যন্ত কর্নার টারেটের ব্যবহার, বাদশাহ-কি-তাখ্ত, পাথর দ্বারা আবৃত মসজিদটি সুলতানি আমলে নির্মিত বাংলার ছোট সোনা মসজিদ, বাঘা শাহী মসজিদ, দারসবাড়ি মসজিদের সঙ্গে তুলনীয়। মসজিদের সামনের অংশে ৭৭ বিঘার একটি বিশাল প্রাচীন দিঘি রয়েছে যা মুসল্লিদের অজু ও গোসলের কাজে ব্যবহৃত হতো। মসজিদটি ৯৬৬ হিজরি বা ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে তৈরি। শেরশাহের বংশধর আফগান সুলতান প্রথম গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহের শাসনামলে (১৫৫৮-১৫৬০) সালে জনৈক সোলায়মান কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়।
মসজিদটির গুরুত্ব উপলব্ধি করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে এবং অর্থ মন্ত্রণালয় ১৯৭২ সালে পাঁচ টাকার নোটে মসজিদটির ছবি মুদ্রিত করে মুদ্রা চালু করে।
সংরক্ষিত ঐতিহাসিক স্থাপনাটি দেখভাল করে থাকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। ১৫ বছর ধরে স্থানীয় বাসিন্দা ইমাম আলী মসজিদের মূল খাদেম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মসজিদটি বাংলার স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। ইটের গাঁথুনি, সামান্য বক্র কার্নিশ এবং সংলগ্ন অষ্টকোনাকৃতির পার্শ্ববুরুজ প্রভৃতি এ রীতিকে সমর্থন করে।
কুসুম্বা মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য ইমামের দায়িত্বে আছেন ওবায়দুল হোসেন, আর শুক্রবার জুমার নামাজের ইমামতির দায়িত্ব পালন করছেন মোস্তফা আলী। সম্প্রতি কথা হয় তাদের সঙ্গে। তারা জানালেন, ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে এ মসজিদের তিনটি গম্বুজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ওবায়দুল হোসেন ও মোস্তফা আলী আরও জানান, মসজিদের ভেতরে চারটি কাতারে প্রায় ৮০ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। এ ছাড়া মসজিদের সামনের অংশে খোলা স্থানে প্রায় ৭০০ মুসল্লি জামাতে নামাজ আদায় করতে পারেন। প্রতি শুক্রবার ও বছরে দুই ঈদের জামাতে মসজিদের ভেতর ও বাইরের পুরো চত্বর মুসল্লিতে ভরে যায়। এ ছাড়া পবিত্র রমজানে তারাবিহর নামাজও পড়া হয় এখানে।
এ বিষয়ে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কাস্টোডিয়ান মুহাম্মদ ফজলুল করিম আরজু ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, কুসুম্বা মসজিদটি নওগাঁর ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আসেন মসজিদটি দেখার জন্য। দর্শনার্থীদের সুযোগ-সুবিধার জন্য অজু ও গোসলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা ছাড়াও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। দর্শনার্থীদের আরও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য এরইমধ্যে পিকনিক স্পট ও বিশ্রামাগার নির্মাণ হয়েছে। দর্শনার্থীদের জন্য আরও বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এসএন