টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের নয়, দাবি ভারতের
ছবি সংগৃহিত
এই দেশেরই মসলিন তাঁতশিল্পীদের বংশধরদের হাতে বুনন শুরু। কমপক্ষে আড়াই শ বছরের ঐতিহ্য। সেই টাঙ্গাইল শাড়িকেই নিজেদের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিল ভারত। ভারতের এমন দাবি নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে বাংলাদেশিরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে ব্যাপক সমালোচনা। এখন প্রশ্ন উঠেছে, ভারত জিআই স্বীকৃতি দেওয়ার পর টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে কী করবে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।
টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি বাংলাদেশে নয়, বরং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বলে দাবি করেছে দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। গত ২ জানুয়ারি নিজেদের জিওগ্র্যাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা জিআই পণ্য হিসেবেও এ শাড়িকে স্বীকৃতি দিয়েছে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে জিআই পণ্য। তাই কোনো একটি পণ্যকে এর তালিকাভুক্ত করতে মুখিয়ে থাকে দেশগুলো। কিন্তু জটিলতা বাঁধে যখন একই পণ্যকে একাধিক দেশ নিজেদের বলে দাবি করে। এমনটাই ঘটেছে টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে।
ভারতের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে গত বৃহস্পতিবার করা এক পোস্টে বলা হয়েছে, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত। এটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর মিহি গঠন, বৈচিত্র্যময় রঙ এবং সূক্ষ্ম জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত। এটি এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। টাঙ্গাইলের প্রতিটি শাড়ি ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে দক্ষ কারুকার্যের নিদর্শন।’
এদিকে, টাঙ্গাইলের শাড়ি নিয়ে ভারতীয় দাবির প্রতিবাদে এবং বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে জিআই স্বীকৃতির দাবিতে বিক্ষোভ করেছে টাঙ্গাইলের একদল তরুণ।
শনিবার দুপুরে টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সামনে সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে এ বিক্ষোভ করেন তারা। এতে বক্তব্য রাখেন, শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠাতা মুঈদ হাসান তড়িৎ, সমাজকর্মী নাদিউর রহমান আকাশ, আহসান খান আকাশ, মির্জা রিয়ানসহ আরও অনেকে।
গবেষকদের মতে, টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি বাংলাদেশে। এর নামের মধ্য দিয়েই তা উঠে এসেছে। ইতিহাসও টাঙ্গাইল শাড়িকে বাংলাদেশের বলে সাক্ষী দেয়। সে বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আশফাক হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেকোনো স্থানের ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে সেখানকার সাংস্কৃতিক ইতিহাস গড়ে ওঠে। টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাসটিও তাই। বাংলাদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ হওয়ায় টাঙ্গাইলের ছেলেরা পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে লুঙ্গি-গামছা। এ অঞ্চলের মেয়েরা পরিধান করে শাড়ি, যা টাঙ্গাইল শাড়ি হিসেবে পরিচিত হয়েছে। টাঙ্গাইল অঞ্চলটি যখন থেকে গড়ে ওঠে তখন থেকেই এ শাড়ি তৈরি শুরু হয়। এ শাড়ির নাম থেকেই এর উৎপত্তি বোঝা যায়।’
বাংলাদেশের বেশকিছু পণ্যের জনপ্রিয়তা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে জায়গা করে নিয়েছে বিদেশের মাটিতে। বিশেষ করে অবস্থানের কারণে পেয়েছে জিআই স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতি থাকা পণ্যটি দেশের পাশাপাশি বিদেশের বাজারেও আধিপত্য করে বেড়ায়। অন্যদিকে, সফট পাওয়ার (প্রভাব বিস্তারক) হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরে। বাণিজ্যিক সুবিধা পাওয়া তখন সহজ হয়।
দেশে ২০১৩ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়। ২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জিআই পণ্যের নিবন্ধন নিতে আহ্বান জানায় পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। ডব্লিউআইপিও নিয়ম মেনে পণ্যের স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে সরকারের এ বিভাগটি।
এ বিষয়ে ডিপিডিটির সহকারী পরিচালক মো. বেলাল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় জিআই পণ্য এগিয়ে থাকে। এর দাম ২০ শতাংশ কখনো বা এরও বেশি হয়। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর পণ্যগুলো আগের চেয়ে অধিক পরিমাণে রফতানি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।’
টাঙ্গাইল শাড়িকে ভারত জিআই স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটিকে এখনো জিআই পণ্য হিসেবে আমাদের দেশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে কেন ভারত তালিকাভুক্ত করেছে সেটি প্রথমে বুঝতে হবে। ভারতের কোথাও টাঙ্গাইল নামে কোনো জায়গা আছে কিনা অথবা যদি অন্য কোনো কারণ থেকে থাকে সেটি জানতে হবে।’
দেশে প্রথম পর্যায়ে জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে জামদানি। তারপর একে একে আসে ইলিশ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম, মসলিন, বাগদা চিংড়ি, কালিজিরা চাল, বিজয়পুরের সাদা মাটি, রাজশাহী সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম। গত আট বছরে মোট ২১ পণ্য জিআইয়ের স্বীকৃতি পেয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল প্রপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) সংজ্ঞা অনুসারে, জিআই বলতে কোনো পণ্যের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান, নাম বা চিহ্নকে বোঝায়। ভৌগোলিক কারণে সে পণ্যের আলাদা গুণ ও খ্যাতি থাকতে হয়। যেহেতু এর গুণাগুণ ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে, কাজেই পণ্য ও এর উৎপত্তিস্থলের মধ্যে সুস্পষ্ট সম্পর্ক থাকে।
বাংলাদেশের বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ির উৎস পশ্চিমবঙ্গ-এমনটা দাবি করেছে ভারতীয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। বিতর্কিত দাবিটি মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল পেজে একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে করা হয়েছিল, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা ও হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে।
পোস্টে দাবি করা হয়েছে, “টাঙ্গাইল শাড়ি, পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত একটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস। সূক্ষ্ম উপস্থাপন, প্রাণবন্ত রং এবং জটিল বুননের জন্য শাড়িটি বিখ্যাত, এটি এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। প্রতিটি টাঙ্গাইল শাড়ি দক্ষ কারুকার্যের প্রমাণ; এটি ঐতিহ্য এবং কমনীয়তাকে একত্রিত করে।“
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ি আড়াইশ’ বছরের ঐতিহ্য। তাঁতের শাড়িসহ তিনটি পণ্য জিআই হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া আমরা কার্যক্রম শুরু করেছি। আমরা আশাবাদী জিআই স্বীকৃতি পাবো। ভারত জিআই আবেদন করলে টাঙ্গাইল শাড়ির ব্র্যান্ডিং করা হয়। এ নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এই তাঁত শাড়ী জিআই পণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে সভা অনুষ্ঠিত হয়। টাঙ্গাইল শাড়ি জিআই করতে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেয়া হবে।