হারিয়ে যাওয়া ১২৫ বছরের চকহরিপুর প্রাচীন মসজিদ
অশিক্ষা, কুশিক্ষা থেকে ভ্রান্তি, অজ্ঞতা, নিরক্ষরতা, বর্বরতা ও অহংবোধ মুসলিম জাতিকে কালের পর কাল শুধু পিছিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি তাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে আমাদের রাসূল মহামানব হযরত মুহম্মদ (সা.) এর মহান বাণীসমূহও। গ্রাম্য শালিশকারী ভূ-স্বামীরা যে কত নির্দয়-নিষ্ঠুর হতে পারে তা এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদ ভেঁঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে নুন্যতম স্মৃতিটুকুও ধরে না রাখার নোংরা মানসিকতা থেকেই বোঝা যায়। সরকারি সর্দাররা তো দূরে থাক, এলাকার উঠতি বয়সের শিক্ষিত যুবক-তরুণরা পর্যন্ত বাঁধা দেয়নি, অনুধাবণ করেনি মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব।
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার চকহরিপুর গ্রামে একশত পঁচিশ বছরের অধিক একটি ঐতিহ্যবাহী নান্দনিক পুরাতন মসজিদ ছিল!! কিছুদূরে কোন এক পুরাতন মরা নদীর স্রোতের প্রবাহ ছিল, যার জেগে ওঠা চরের উপর শেখ বংশের বসতবাড়ির সীমানায় মসজিদটি অবস্থিত ছিল যা এখন ‘চকহরিপুর প্রাচীন মসজিদ’ নামে বহুল পরিচিত। প্রথমে মসজিদটি কাঁচা স্থাপনার টিনের ছাউনি দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। ঐ সময়ে অত্র অঞ্চলের জমিদার শেখ ইছাহক আলী ঘোড়ায় চড়ে পাবনায় যেতেন দাপ্তরিক কাজে এবং যাত্রাপথে ভাঁড়ালা গ্রামের ঐতিহাসিক একটি মসজিদে নামাজ আদায় করতেন। তখন তাঁর মনে স্বপ্ন জাগে অনুরূপ একটি মসজিদ তৈরির। অত:পর তিনি মুঘল স্থাপত্যকলার নক্শা অনুযায়ী মসজিদ তৈরির নিমিত্তে বাংলা ১৩০০ সনে (ইংরেজি ১৮৯৩) তাঁর নিজস্ব জায়গার উপর মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু তিনি মসজিদের নির্মাণকাজ শুরুর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ আব্দুস ছাত্তার কলকাতা থেকে নিপুণ কারিগর এনে সাড়ে বারো হাজার টাকা ব্যয় করে মসজিদের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন।
মসজিদটি ৪২ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ২২ ফুট প্রস্থের তিনটি কাতারে নামাজ আদায় করা যেত এবং প্রতি কাতারে ২৫ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারতেন। মসজিদের দেয়াল ছিল ২৫ ইঞ্চি চওড়া ও চুন-সুরকি ইটের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি। আর শুধুই টালি ইটের দ্বারা গাঁথুনি করে তিনটি সমান গম্বুজ ছিল যা আভিজাত্যের প্রতীক নির্দেশ করতো। মসজিদের সুদৃশ্য মেহরাব ছিল। উত্তর-দক্ষিণে একটি করে দুটি জানালা এবং পূর্বদিকে তিনটি দরজা ছিল প্রবেশদ্বার হিসেবে। মসজিদের নির্মাতা শেখ আব্দুস সাত্তার ছিলেন তৎকালীন নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর কোর্টের জুরি বোর্ডের সদস্য। তিনি অনুমানিক ১৯২০ সালে মাত্র চল্লিশ বৎসর বয়সে অকালপ্রয়াণ করেন। অত:পর জমিদার শেখ ইছাহক আলী’র মৃত্যুকালীন ওছিহত অনুযায়ী তাঁর দ্বিতীয় পুত্র শেখ আব্দুল আহাদ স্বপ্রণোদিত হয়ে তামাম শরীকদের কাছ থেকে দাবী করে ৩ একর ২৩ শতক জমি নিয়ে মসজিদের নামে ওয়াক্ফ করে দেন। পরবর্তীতে মসজিদের পাশ দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের খাল খনন হলে জমির পরিমাণ কমে যায়। মসজিদের দৃষ্টিনন্দন নান্দনিকতা ও স্থাপত্যশৈলী তখন সমগ্র খোকসা, কুমারখালী ও রাজবাড়ী অব্দি বহু অঞ্চলে ছিল মানুষের মুখে মুখে। দর্শনার্থীদের ভিড়ও ছিল। সেই সাথে তৎকালীন সময়ে চকহরিপুর প্রাচীন মসজিদটি ছিল শোমসপুর, মাসিলিয়া, উত্তরশ্যামপুর, সন্তোষপুর গ্রামের মুসল্লীদের নামাজ আদায় করার এক মাত্র মসজিদ। ২০১৪ সালে নান্দনিক মসজিদটি গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন স্থাপনার একতলা মসজিদ নির্মিত হয়েছে যেখানে আটটি কাতার রয়েছে ও প্রতি কাতারে ৩০ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।
ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক
ডিএসএস/