তাহখানা কমপ্লেক্স
সোনা মসজিদ ছাড়িয়ে আর প্রায় অর্ধ কিলোমিটার সামনেই সড়কের উল্টোদিকে পড়ে তাহখানা কমপ্লেক্স। এখানে পাশাপাশি তিনটি স্থাপনা পাওয়া যায়। একটি তাহখানা, একটি মসজিদ ও একটি মাজার। এই স্থাপনাগুলো মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে তার ভাই বাংলার সুবাহদার শাহ সুজার নির্মাণ করা। নির্মাণকাল ১৬৩৯-১৬৬০ সালের মধ্যে।
সম্রাট শাহজাহানের চার পুত্র দারাশিকো, শাহ সুজা, আওরঙ্গজেব ও মুরাদ বক্সের বিরোধের গল্প প্রায় সবারই জানা। শাহ সুজাকে বাংলার সুবাহদারীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি ধর্মগুরু হিসেবে মানতেন সুফী শাহ নেয়ামতউল্লাহ ওয়ালীকে, যার আখড়া ছিল গৌড়ে। গ্রীষ্মকালে অসম্ভব গরম পড়ত গৌড়ে। তাই এখানেই একটি শীতল প্রাসাদ এবং একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ বানিয়ে দিয়েছিলেন শাহ সুজা। শাহ নেয়ামতউল্লাহর মৃত্যুর পর একটি মাজার বানিয়ে দেওয়া হয়।
একটি বিশাল আকারের পুকুরের গা ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছিল তাহখানা বা শীতল প্রাসাদটি। এটি এমনভাবে বানানো, যে প্রাকৃতিক বাতাস এক দিক থেকে প্রবেশ করবে, কিন্তু ভবনের ভেতরেই ঘুরপাক খেয়ে আরেক দিক দিয়ে বের হয়ে যাবে। এই স্বাভাবিক বায়ু চলাচলের মধ্যেই প্রবেশ করা উষ্ণ বাতাস ভেতরে শীতল হয়ে যাবে। আবার শীতকালে একইভাবে উল্টো দিক থেকে প্রবেশ করা শীতল বাতাস ভেতরে প্রবেশ করে ঘুরপাক খেয়ে উষ্ণতা বেড়ে যাবে। কাজেই সারা বছর ভবনটির ভেতরে তাপমাত্রা খুব বেশি গরমও যেমন থাকবে না, আবার খুব বেশি শীতলও থাকবে না।
হাল আমলের স্থাপনাগুলোর মধ্যে আমরা যদি বাংলাদেশের সংসদ ভবনের সঙ্গে তুলনা করি, এই স্বাভাবিক বায়ু চলাচল করে ভবনকে নাতিশীতোষ্ণ রাখার জন্য যে প্রযুক্তি স্থপতি লুই কান ব্যবহার করেছিলেন, সেই একই প্রযুক্তি এই তাহখানায় ব্যবহার করেছিলেন শাহ সুজা। সময়ের ব্যবধান কেবল তিনটি শতক!
তাহখানা থেকে পুকুরে নামার জন্যও রয়েছে লুকানো সিঁড়ি। এটি ছিল নারীদের ব্যবহারের জন্য। আবার পুকুর থেকে উঠানো পানি চুলায় গরম করে running hot water এর ব্যবস্থাও ছিল ভবনের এই হাম্মামখানা অংশটিতে।
কথিত আছে, আওরঙ্গজেব যখন শাহ সুজাকে হত্যার জন্য প্রায়শই লোক পাঠাতেন, তখন কিছুদিনের জন্য শাহ সুজা সপরিবারে রাজধানী ঢাকা ছেড়ে এই তাহখানাতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন।
খনিয়াদিঘী মসজিদ
আমাদের পরিকল্পনা ছিল তাহখানা কমপ্লেক্সের পর দারসবাড়ি মসজিদ ও মাদরাসা দেখার। কিন্তু রাস্তা খুঁজে না পেয়ে আমরা চলে আসি খনিয়াদিঘী মসজিদটি দেখার জন্য। বাংলাদেশ-ভারত বর্ডার পোস্টের ঠিক আগেই হাতের ডানদিকে একটি রাস্তা দিয়ে আসতে হলো। এই মসজিদ পর্যন্ত গাড়ি যাওয়ার পথ নেই। তাই নির্ধারিত পার্কিং স্পটে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে কয়েকশত গজ এগিয়ে পৌঁছালাম আমরা খনিয়াদিঘী মসজিদে। হাতের বাঁয়ে পড়ল বিশাল এক দিঘী, এটির নাম খনিয়া দিঘী।
ধারণা করা হয়, ১৪৮০ সালে সুলতানি রাজসভার কোনো এক রাজবিবি এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এ কারণে এটি স্থানীয়ভাবে রাজবিবি মসজিদ নামেও পরিচিত। স্থানীয়ভাবে এটির অবশ্য আরেকটি অদ্ভুত নাম আছে - চামচিকা মসজিদ। সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটি চমৎকারভাবে সংস্কার করেছে। তবে এর আগে মসজিদটি বহু বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। হয়তো সে সময়েই বাদুড় বা চামচিকার উপস্থিতির কারণে সেই নামটি করা হয়েছিল।
লম্বায় ও চওড়ায় মসজিদটি ৬২ ফুট ও ৪২ ফুট হলেও ভেতরের কামরাটি ২৮ ফুট বর্গাকার। পুব থেকে প্রবেশের তিনটি দরজা আছে। একটি প্রশস্ত বারান্দা পেরিয়ে মসজিদের মূল কক্ষে প্রবেশ করতে হয়। বারান্দার ছাদে দরজাগুলোর উপর বরাবর রয়েছে তিনটি ছোট অর্ধ বৃত্তাকার গম্বুজ। আর মূল ভবনের ছাদে একটিমাত্র বৃহৎ অর্ধ বৃত্তাকার গম্বুজ।
ইটে গড়া মসজিদটির দেয়ালে শোভা পাচ্ছে ইটে খোদাই করা নকশা ও টেরাকোটা। মূল ভবনের চার কোণে এবং বারান্দার সামনে দুই কোণে মোট ছয়টি প্রশস্ত অষ্টভূজাকার পিলার গেঁথে কাঠামোকে দৃঢ়তা দেওয়া হয়েছে।
১৫শ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধ থেকে গড়া বড় মসজিদগুলোর অধিকাংশেই ছিল বারান্দা। এটি আগের গড়া মসজিদগুলোতে দেখা যায় না। হয়তো এটি ছিল সে সময়ে নতুন একটি স্থাপত্যবিষয়ক উদ্ভাবন! টেরাকোটার নিখুঁত কাজগুলো দেখলে ভাবতেই অবাক লাগে, চারশো-পাঁচশো বছর আগে প্রযুক্তির কতটুকুই বা প্রাপ্যতা ছিল! সেগুলো ব্যবহার করেই কারিগররা এমন নিখুঁত কাজ করেছিল!
ধুনি চক মসজিদ
খনিয়াদিঘী মসজিদ দেখে এবার আমরা ফেরার পথ ধরেছি। কিছুটা এগিয়েই আবার রাস্তার বাঁ পাশের এক গলি ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলাম। এই মসজিদ পর্যন্তও গাড়ি যাওয়ার রাস্তা নেই। আমবাগান পেরিয়ে যেতে হলো। তবে মসজিদটি দেখে বিস্মিত হতেই হবে। এর নির্মাণকাল সঠিকভাবে জানা যায় না। সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এর সংস্কার করেছে, তবে এখানে কোনো সাইনবোর্ড নেই, যা থেকে সঠিক ইতিহাস জানা যাবে।
১৫শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সুলতানি আমলের আদলে গড়া ইটে নির্মিত একটি মসজিদ এটি। এই এলাকার মানুষ ঐতিহাসিকভাবে তুলা ধুনার কাজ করত বলেই হয়তো মসজিদটির ধুনি চক নাম দেওয়া হয়েছিল।
৪৫ ফুট লম্বা এবং ৩০ ফুট প্রশস্ত মসজিদটির দেয়াল প্রায় ৬ ফুট চওড়া। ছাদে গম্বুজ তিনটি মসজিদের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে বেশ ছোট, যা গৌড় এলাকার মসজিদের নকশায় বিরল।
দারসবাড়ি মসজিদ
আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল দারসবাড়ি মসজিদ ও মাদরাসা। প্রায় সম্পূর্ণভাবে ইটে গড়া দারসবাড়ি মসজিদটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১১২ ফুট এবং প্রস্থে প্রায় ৬৮ ফুট হলেও ভেতরের দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ ফুট এবং প্রস্থ প্রায় ৩৪ ফুট। মসজিদটির দেয়াল প্রায় ৬ ফুট চওড়া। পুবপাশে প্রবেশের মুখেই রয়েছে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ১০ ফুট প্রশস্থ একটি বারান্দা। পাথরে নির্মিত পিলার গেঁড়ে তার চারপাশে ইট গেঁথে মসজিদটির স্তম্ভগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। চার কোণে চওড়া ইঠের পিলার বানিয়ে মসজিদের অবকাঠামো দৃঢ় করা হয়েছিল। ৭টি খিলান আকৃতির উন্মুক্ত দরজা দিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করে তারপর মসজিদে প্রবেশ করতে হতো। উত্তর দিকে দুইটি এবং দক্ষিণে তিনটি দরজা দিয়েও প্রবেশ করা যেত।
নামাজের কক্ষটি ছিল তিন ভাগে বিভক্ত। মাঝখানের মূল কক্ষটি বড়, আর দুই পাশে ছোট দুটি অংশ। উত্তরের অংশে পাথরের স্ল্যাব বসিয়ে দোতলায় একটি কক্ষ বানানো ছিল, যেটির জন্য ছিল একটি ভিন্ন প্রবেশ পথ এবং সিঁড়ি। এর দরজার সামনে থাকত রক্ষী। সম্ভ্রান্ত কোনো অতিথি বিভিন্ন ওয়াক্তের জামাতের সময় ব্যতিত অন্য কোনো সময়ে এই মসজিদে কখনো একা নামাজ পড়তে এলে তার জন্য এই অংশটি খুলে দেওয়া হতো। এজন্য এই অংশটির নাম ছিল মসজিদের রাজকীয় গ্যালারি। তবে জুম্মার নামাজের সময় এটি হয়ে যেত নারীদের নামাজ পড়ার স্থান। এ অংশটি অবশ্য এখন একেবারেই ভেঙে পড়েছে।
মসজিদটির ছাদটি নির্মাণ করা হয়েছিল একটু ভিন্ন ধরনের ডিজাইনে। মূল কক্ষের মাঝখানে ছিল একটি বিশাল চৌচালা গম্বুজ। তার সামনে এবং পেছনে ছিল একটি করে ছোট চৌচালা গম্বুজ। এই তিনটির দুই পাশে ছিল এক সারিতে তিনটি করে ছয়টি গোলাকার মাঝারি আকারের গম্বুজ। উত্তর ও দক্ষিণের ছোট কক্ষগুলোর উপর ছিল ছয়টি করে ছোট গোলাকার গম্বুজ। বারান্দার উপর মাঝখানে একটি চৌচালা এবং এর দুই পাশে তিনটি করে ছয়টি গোলাকার ছোট গম্বুজ। অর্থাৎ, মোট ছিল চারটি চৌচালা এবং ২৪টি গোলাকার গম্বুজ। দারসবাড়ি মসজিদের গম্বুজের এই নকশাটিকেই গৌড়ীয় নকশার পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এই আদলে ভারতবর্ষব্যাপী আরও বেশ কিছু মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে কোনো এক ভূমিকম্পে মসজিদটির ছাদ ভেঙে পড়ে, যা আর কখনই পুনঃনির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। মসজিদটিও আর ব্যবহারযোগ্য করা যায়নি।
ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে মোট ১১টি মেহরাব, যার দুটি রয়েছে রাজকীয় গ্যালারিতে। ভেতরের দেয়ালে কোনো প্লাস্টারের কাজ করা হয়নি কখনোই। পুরো দেয়ালে ছিল শুধু ইটের কারুকাজ। আর মেহরাবগুলো সাজানো হয়েছিল অবিশ্বাস্য সুন্দর এবং নিখুঁত টেরাকোটায়।
কত সহস্র টেরাকোটা টালি যে ব্যবহার করা হয়েছিল মসজিদটির ভেতরে, তার হিসাব নেই। বেশ কিছু জায়গায় ভেঙে গেলেও এখনোও যেটুকু টিকে আছে, দেখে মুগ্ধ হতেই হবে। জ্যামিতিক আকার, ফুল ও লতার ডিজাইনে নির্মাণ করা হয়েছিল এই টালিগুলো। একেকটি একেক রকম, পাশাপাশি বসিয়ে পুরো নকশাটি সৃষ্টি করা। দূর থেকে দেখলে সবগুলো মেহরাব একইরকম মনে হলেও কাছে গিয়ে দেখলে বুঝা যায় একেকটি মেহরাবের ডিজাইন ডিটেইলে সামান্য কিছু পার্থক্য রাখা হয়েছিল। এতটা ডেলিকেট ও নিখুঁত টেরাকোটা ডিজাইন কোনো মসজিদের ভেতর খুব কমই দেখা যায়।
মসজিদটিতে যাওয়ার সময় পুর্ব ও দক্ষিণের দেয়াল দুটিই চোখে পড়ে। পুর্বের দেয়ালে খিলান ছাড়া আর তেমন কোনো চিহ্ন নেই। দক্ষিণের দেয়ালে কিছু টেরাকোটা এবং বেশ কিছু খোদাই করা ডিজাইন চোখে পড়ে। উত্তরের দেয়ালেও প্রায় একই। পশ্চিমের দেয়ালটি একেবারেই ভিন্ন। মাঝখানে মূল মেহরাবের অংশটি কিছুটা বের করা। বাকি পুরো দেয়ালের ইটে খোদাই করে নকশা করা। নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর একই ডিজাইনের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এপাশে সাতবার, ওপাশে সাতবার। দীর্ঘ সময়, বৈরী আবহাওয়া এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কিছু কিছু খোদাই করা অংশ ক্ষয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও অপূর্ব সুন্দর লাগে দেখতে।
মসজিদের পুবপাশে বড় একটি পুকুর। তার পরেই হলো দারসবাড়ি মাদরাসা। ১৫০৪ সালে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এটি নির্মাণ করেছিলেন। কুমিল্লার শালবন বিহারের আদলে নির্মিত চতুর্ভূজাকার ভবনটির একেক দিকের দৈর্ঘ ১৮২ ফুট। রুমগুলো সব চারিদিকে। এতে রয়েছে ১০ ফুট ও ১০ ফুট মাপের ৪০টি রুম এবং চত্ত্বরের মাঝখানে একটি বড় ক্লাসরুম।
গৌড়ের সমসাময়িক মসজিদগুলোর মধ্যে কেবল এখানেই একটি মাদরাসা স্থাপন করা হয়েছিল।
কোনো কোনো গবেষকের মতে মসজিদটি স্থাপনের সময় এলাকার নামানুসারে এর নাম ছিল ওমরপুর মসজিদ। পরবর্তী সময়ে মাদরাসা স্থাপনের পর এটিও দারসবাড়ি নাম ধারণ করে। নামটির পেছনে যুক্তিও আছে বলে ধারণাটি ফেলে দেওয়া কঠিন।
সুলতানি আমলে দাপ্তরিক ভাষা ছিল ফার্সি। এই ফার্সি ভাষায় “দার্স” শব্দটির অর্থ “পড়া”। তাই পড়ালেখার জন্য বিশাল এই আবাসিক প্রতিষ্ঠান (মাদরাসা) প্রথম থেকেই “দার্সবাড়ি” নামেই পরিচিত ছিল। এর ছাত্ররা এই মসজিদেই ওয়াক্তের নামাজ আদায় করত বলে মসজিদটির “দার্সবাড়ি মসজিদ” নাম হয়ে যায়। দার্সবাড়ি থেকে দারসবাড়ি হতে সময় লাগেনি! এই এলাকাটিও এখন দারসবাড়ি নামে পরিচিত। এখানে মানুষ দারসবাড়ি মসজিদ ও দারসবাড়ি মাদরাসা নামেই এগুলোকে চিনে।
সময় গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। চৈতির বাগান অর্থাৎ পি্কনিক স্পটে পৌঁছাতে লাগবে দেড় থেকে পৌনে দুই ঘণ্টা। আর দেরি করা গেল না। মসজিদগুলো ঘুরে ঘুরে আরেকটু ডিটেইলে হয়তো দেখা যেত। কিন্তু তাতে সময় তো আর কুলাচ্ছিল না। তাই কিছুটা আফসোস নিয়েই ফেরা হলো। তারপরও এক সকালে এতগুলো প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনা দেখা গেল, তাতেই আনন্দ তো আর কম হলো না। বন্ধুদের সঙ্গে আরও বড় আড্ডায় যোগ দিতে আমরা রওনা হয়ে গেলাম চৈতির বাগানের উদ্দেশে।
ডা. নাফিসুর রহমান: ডিস্যাবিলিটি ও ডেভেলপমেন্ট কনসাল্ট্যান্ট।
এসএন