হেমু গ্রামের হত্যাযজ্ঞ
পাখি ডাকা ছায়া ঢাকা, সবুজের মায়া আঁকা; ছোট এক গ্রাম। গ্রামের নাম হেমু। হেমু গ্রামের লোকজনের পেশা ছিল কৃষি। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করে কোনো রকম তারা জীবনযাপন করতো। গ্রামে পড়াশোনা জানা মানুষ একজনও ছিল না। তবু জীবন তাদের থেমে থাকেনি। জীবন জীবনের গতিতে চলতো।
হেমু গ্রামের পাশ দিয়ে কুলুকুলু রবে বইতো ছোট একটি নদী। নদীর নাম খরিস। খরিস নদীর উপর ছিল পাকা একটি সেতু। সেতুর নাম খরিস সেতু। এই খরিস সেতু দিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারীরা জলপাই রঙের ট্রাকে চড়ে সব সময় যাওয়া-আসা করতো। তারা বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে ইচ্ছেমতো আক্রমণ চালাতো, লুটপাট করতো।
জৈন্তাপুরে মিলিটারীরা ক্যাম্প বসালো। ক্যাম্প থেকে তারা যখন তখন জীপ কিংবা ট্রাকে চড়ে সশস্ত্র মহড়া দিতো। খরিস সেতু পার হয়ে অজপাড়া গাঁ পর্যন্ত তারা চলে যেতো। গিয়ে এলাকার লোকজনকে ডর-ভয় দেখাতো। কারও বিরুদ্ধে সামান্যতম অভিযোগ পেলে ক্ষমা করতো না। পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলতো। কখনও আবার অভিযোগও লাগতো না। ইচ্ছে হলো ব্যস, গুলি করে দিতো। এভাবে নির্বিচারে চলতো পাকিস্তানি মিলিটারীদের অন্যায় হত্যাযজ্ঞ।
একদিন বিকেল বেলা। হাটবার ছিল সেদিন। হেমু গ্রামের কেরামত আলী আখ বিক্রি করছিলেন জৈন্তাপুর বাজারে। মধ্য বয়স্ক মানুষ কেরামত আলী। অন্যান্য দিনের চেয়ে তিনি সেদিন অনেক আখ বিক্রি করলেন। পকেটে জমা হলো তার চকচকে কাঁচা পয়সা। বেশি পরিমাণ আখ বিক্রি করতে পারায় কেরামত আলীর মনে আনন্দ বিরাজ করছিল। আনন্দে হঠাৎ তার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি।
তার পাশ দিয়েই যাচ্ছিল একটি মিলিটারী জিপ। কেরামত আলী তা খেয়াল করলেন না। আচমকা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শোনার পর পাকিস্তানি মিলিটারীদের শরীরে যেন কেউ আগুন লাগিয়ে দিলো। জীপ থামিয়ে বন্দুক তাক করে ছুটে এলো দুজন মিলিটারী। এসেই আর কোনো কথা নেই। কেরামত আলীসহ আরও চার-পাঁচজনকে গুলি করে মাটিতে ফেলে দিলো। গুলি খেয়ে রক্ত ভেজা মানুষগুলো গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে করতেই মারা গেলেন। চিরদিনের মতো নিথর হয়ে গেল মানুষগুলো। সেই খবর ছড়িয়ে পড়লো সারা বাজারে। লোকজন দোকান পাট বন্ধ করে যে যার মতো পালিয়ে গেল।
সেই ঘটনার পর জৈন্তাপুর অঞ্চলে নেমে এলো কেমন যেন শোকের ছায়া। সব জায়গায় লক্ষ্য করা গেল কেমন যেন থমথমে ভাব। লোকজন কেমন ভয়ে ভয়ে থাকতো। কেউ কারও সাথে তেমন কথা বলতো না। নিতান্ত দরকার না হলে মানুষ খুব একটা বাজার-হাটেও যেতো না। চাপা কণ্ঠে ফিসফিস করে কেউ কেউ বলতো সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। খুব শীঘ্রই বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। সোনার বাংলা শত্রু মুক্ত হবে।” এভাবেই যাচ্ছিল দিন।
তারপর হঠাৎ একদিন এলো ভয়াল সেই রাত। রাতের খাবার খেয়ে হেমু গ্রামের লোকজন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘন অন্ধকার রাত। ঝোপঝাড়ে অবিরাম ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। ঝিঁঝিঁ পোকার সাথে পাল্লা দিয়ে ঝাঁক ঝাঁক জোনাক পোকা জ্বলছে আর নিভছে।
এমনি সময়ে রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে শো-শো আওয়াজ তুলে কোথা থেকে যেন উড়ে এলো তিন তিনটি জঙ্গি বিমান। বিমানগুলো যে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর তা পরে জানা গেল। বিমানগুলো উড়ে এসে জৈন্তাপুরের আকাশে ঘুরে ঘুরে কয়েকবার চক্কর খেলো। তারপর আচমকা শুরু করলো বোমা বর্ষণ। সব কয়টি বোমাই এসে পড়লো হেমু গ্রামের ওপর। আকস্মিক বোম্বিংয়ের কারণে অনেক লোক ঘুমন্ত অবস্থাতেই মারা গেল। বোম্বিংয়ের শব্দে হেমু গ্রামের লোকদের কারও কারও ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে জেগে গ্রামের লোকজন যেন বোবা হয়ে গেল। তারা দেখে কী, তাদের প্রিয় গ্রামখানি দাউদাউ করে জ্বলছে। আগুনের লেলিহান শিখা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। যেসব স্থানে বোমা পড়েছিল, সেই সব জায়গায় এক একটা পুকুর তৈরি হয়ে গেল।
জীবিত মানুষ প্রাণ ভয়ে দিকবিদিক ছুটতে লাগলো। সেই রাতে হেমু গ্রামের অনেক নিরীহ মানুষ মারা গেল। হারিছ আলী, ছাড়া মিয়া, আয়েশা বেগম, আব্দুল্লাহ, নাছিমা বেগম, ইছাক আলী ও আলেকজান বিবিসহ কয়েক শত নিরীহ মানুষ বোমার আঘাতে শহীদ হলেন।
সেই রাতে কেউ কেউ কোনো রকম জান নিয়ে পালিয়ে বাঁচলো। অনেকের মতো লেংগুই মিয়া এবং তার বউও পালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাঁচতে পারেননি। লেংগুই মিয়ার বউয়ের কোলে ছিল ছোট একটি শিশু। দিকদিশা হারিয়ে বউকে নিয়ে হুড়মুড় করে পালাতে গিয়ে ঘটলো বিরাট এক অঘটন। নদীর ধারে এসে লেংগুই মিয়ার বউ হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ‘আমার ময়না পাখি’ ‘আমার ময়না পাখি’ বলে বউটি আহাজারি শুরু করে দিলো।
লেংগুই মিয়া দেখলেন বউয়ের কোলে তাদের শিশু বা”চাটা নেই। নেই কেন? ভাবতে লাগলেন তিনি।
পরে বউটি নিজ থেকেই বললো, “আমার সব্বনাশ অইয়া গেছে গো। সব্বনাশ অইয়া গেছে। তাড়াহুড়া কইরা আইতে গিয়া ভুল কইরা আমি আমার ময়না পাখি রে ঘরো থুইয়া আইয়্যা পড়ছি। ময়না পাখির বদলে আমি তার বালিশটা লইয়্যা আইয়্যা পড়ছি। এহন আমার কী অইবো গো। কী নিয়া আমি বাঁচুম গো।” বলে বউটি গলা ফাটিয়ে রীতিমতো মরাকান্না শুরু করে দিলো।
বউয়ের কান্না শুনে লেংগুই মিয়া বললেন, “কান্দিছ না বউ। তুই এই হানো ব। আমি যাইয়াম আর আইয়াম। আমি ময়না পাখি রে ঠিক লইয়্যা আইয়াম। তুই কুনো চিন্তা করিছ না।”
বলে লেংগুই মিয়া হেমু গ্রামের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন। এক দৌড়ে তিনি চলে এলেন হেমু গ্রামে। এসে দেখলেন, তার ছনের ঘরখানি দাউদাউ করে জ্বলছে। ঘরের ভেতর শোনা যাচ্ছে ছোট্ট শিশুর কান্না। লেংগুই মিয়া চিনতে পারলেন সেই কণ্ঠ। তারপর এক লাফে গিয়ে তিনি ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন। ততক্ষণে শিশুটির কান্না থেমে গেছে। লেংগুই মিয়া ঘরের ভেতর ঢুকতেই হঠাৎ ঘরের চালটি তার উপর খসে পড়লো। কিছুতেই তিনি আর ঘর থেকে বেরোতে পারলেন না।
সকাল বেলা লোকজন এসে লেংগুই মিয়ার ঘরের খালি জায়গাটাতে আবিষ্কার করলো ছাইয়ের উঁচু স্তূপ। ছাইয়ের ভেতর জড়াজড়ি অবস্থায় পাওয়া গেল আধ পোড়া দুটো মানব কংকাল। একটি ছোট্ট শিশুর। আর অন্যটি একজন বয়স্ক মানুষের।
গবেষণা কর্মকর্তা
ট্রাস্টিবোর্ড অফিস, লিডিং ইউনিভার্সিটি
রাগীবনগর, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট-৩১১২
ডিএসএস/