চাঁপাই নবাবগঞ্জে ঐতিহ্যের সন্ধানে
গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ শাহ বঙ্গকে দিল্লির শাসন থেকে মুক্ত করে স্বাধীন অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেন এবং রাজধানী গৌড় থেকে স্বাধীন বঙ্গের পরিচালনা আরম্ভ হয়। তিনি বঙ্গ জুড়ে অসংখ্য মসজিদ নির্মাণ করেন এবং জুম্মার খুৎবায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করান। তারই সময়ে এই অঞ্চলে ইসলামি শিক্ষার প্রচলন করা হয়।
১২২৭ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গের পাশাপাশি বিহার দখল করার যুদ্ধে তৃতীয় সুলতানি শাসক ইলতুতমিশের বাহিনীর হাতে গিয়াস উদ্দিনের মৃত্যু ঘটলে বঙ্গের শাসন আবার দিল্লির অধীনে চলে যায়।
১২৮১ সালে বঙ্গের প্রশাসক নাসিরুদ্দিন বোঘরা খান আবার দিল্লির শাসন থেকে বঙ্গের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৩৪২ সালে পার্শ্ববর্তী সাতগাঁও এর প্রশাসক শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ গৌড়ের প্রশাসককে পরাজিত করে একটি বৃহত্তর এলাকাকে দিল্লির শাসন থেকে স্বাধীন করেন। তাকেই বলা হয় বঙ্গের সুলতানি আমলের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বঙ্গের রাজধানী গৌড় থেকে সরিয়ে পন্ডুয়াতে নিয়ে যান। প্রায় এক শতাব্দী পর বঙ্গের শাসক সুলতান মাহমুদ শাহ রাজধানীকে আবার গৌড়ে ফিরিয়ে আনেন। ১৫৬৫ সাল পর্যন্ত সুলতানি আমল শেষ হয়ে গেলেও মোঘল আমলের গোড়ার দিক পর্যন্ত গৌড় বঙ্গের রাজধানী ছিল।
১৫২৬ সালে মির্জা জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বা সম্রাট বাবরের মাধ্যমে আরম্ভ হয় মোঘল সাম্রাজ্য। এই সময়েই বঙ্গ আবার দিল্লির অন্তর্গত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় মোঘল সম্রাট হুমায়ুন ১৫৩৫ সালে (আনুমানিক) গৌড়ে এলে কারুকাজসমৃদ্ধ অসংখ্য মসজিদ দেখে আপ্লুত হন এবং গৌড়কে জান্নাতাবাদ নামে আখ্যায়িত করেন।
সম্রাট হুমায়ুন শের শাহ সুরীর কাছে পরাজিত হলে দিল্লির শাসন প্রায় ২৫ বছরের জন্য থাকে সুরী বংশের হাতে। এই সময়কালে কোনো এক বছর গৌড়জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ভয়ংকর প্লেগ। অসংখ্য নগরবাসী মৃত্যুবরণ করে, বাকি প্রায় সবাই পালিয়ে অন্যত্র সরে যায়। একই সঙ্গে কয়েকটি বড় বড় ভূমিকম্পের ফলে পদ্মা নদীর গতিপথেও কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। ১৫৫৫ সালে হুমায়ুন মোঘল সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেও গৌড় তার কৌশলগত এবং ভৌগলিক গুরুত্ব হারাতে থাকে। অবশেষে ১৫৬৫ সালে গৌড় থেকে চিরকালের জন্যই বঙ্গের রাজধানী সরিয়ে ফেলা হয়। ধীরে ধীরে একটি পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হয় এককালের সমৃদ্ধ ও জনবহুল নগরী গৌড়।
যতগুলো সুদৃশ্য মসজিদ দেখে সম্রাট হুমায়ুন গৌড়কে জান্নাতাবাদ নাম দিয়েছিলেন, তার মধ্যে নিশ্চয়ই আগের শতকে নির্মিত মসজিদগুলোর পাশাপাশি ১৩শ শতাব্দীতে গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ শাহ-এর নির্মিত মসজিদগুলোও ছিল। তবে গত কয়েক শতকে নানা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আর কালের পরিক্রমায় আজ সেগুলো প্রায় সবই হারিয়ে গেছে। সুলতানি আমলের ১৫শ শতাব্দীতে নির্মিত কিছু মসজিদ এবং মোঘল আমলে ১৭শ শতাব্দীর কিছু স্থাপনা প্রাচীন গৌড়ের নিদর্শন হিসেবে বাংলাদেশ সীমানায় এখনো দেখা যায়। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে সংস্কার করার কারণে এগুলো টিকে আছে। এমনই কয়েকটি স্থাপনা দেখার উদ্দেশ্যে আমরা গিয়েছিলাম প্রাচীন গৌড় নগরী, বা আজকের চাঁপাই নবাবগঞ্জ বেড়াতে।
ছোট সোনা মসজিদ
আমাদের ট্রিপের প্রথম স্থাপনা ছিল ছোট সোনা মসজিদ। চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহর পার হয়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমানা পোস্টের দিকে এগিয়ে গেলে সীমানা থেকে ৩ কিলোমিটার আগে মহাসড়কের ডানে পড়বে এই মসজিদ কমপ্লেক্স। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ’র শাসন আমলে ১৪৯৩-১৫১৯ সালের মধ্যে গৌড়ে প্রায় একই নকশায় দুটি মসজিদ গড়া হয়েছিল। বড়টি এখন ভারতের সীমানায় আর ছোটটি বাংলাদেশে। দুটি মসজিদেরই ছাদের গম্বুজগুলো স্বর্ণ দিয়ে মোড়া ছিল বলেই এগুলো সোনা মসজিদ নামে পরিচিত। আজ আর সেই স্বর্ণ নেই, তবে নামগুলো রয়েই গেছে।
ইট ও পাথরে নির্মিত আয়তক্ষেত্রাকার মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৮২ ফুট এবং পুব-পশ্চিমে প্রায় ৫২ ফুট। মূল কাঠামো পাথরে নির্মিত। এর উপরে ইটের স্তর। তার উপর আবার গ্র্যানাইট পাথরের স্তর। যে কারণে দেয়ালগুলো প্রায় ৬ ফুট প্রশস্ত। মসজিদের চার কোণে আরও মজবুত করার জন্য রয়েছে চওড়া অষ্টভূজাকার পিলার। ভেতরে দুই সারিতে চারটি করে মোট আটটি পাথরের পিলার। এগুলোর উপরেই খিলানের উপর নির্মাণ করা হয়েছে ছাদ। ভেতরে উত্তর পশ্চিম অংশে রয়েছে দ্বিতল রাজকীয় গ্যালারি, যার জন্য বাইরে থেকে প্রবেশের জন্য আছে ভিন্ন প্রবেশ পথ ও সিঁড়ি। সুলতানি আমলে নির্মিত বড় মসজিদ্গুলোর এটি ছিল এটি বিশেষত্ব। ওয়াক্তের নামাজের সময় ছাড়া অন্য কোনো সময়ে কেউ এলে তার নামাজ পড়ার জন্য পুরো মসজিদ না খুলে কেবল এই অংশ খুলে দেওয়া হতো। আর জুম্মার নামাজের সময় এই অংশটি নারীদের নামাজের জন্য নির্ধারিত থাকত।
ছাদে রয়েছে ৩ সারিতে মোট ১৫টি গম্বুজ। এর মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণে ৬টি করে ১২টি হলো অর্ধবৃত্তাকার, আর মাঝের তিনটি চৌচালা। পুরো মসজিদের দেয়াল পাথরে মোড়া, এর মাঝে মাঝে রয়েছে খোদাই করা নকশা। কোথাও বা দেয়ালে ব্যবহৃত পাথর খোদাই করে করা হয়েছে নকশা, কোথাও বা বড় পাথরের নকশা করা স্ল্যাব দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। দূর থেকে একেকটি স্ল্যাবে করা নকশাগুলো একইরকম মনে হলেও কাছে এলে তাদের ভিন্নতাগুলো স্পষ্টতই দেখা যায়।
নাফিসুর রহমান: ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপ কনসালটেন্ট।
এসএন