বঙ্গবন্ধু শ্রমিক অন্তঃপ্রাণ মানুষ ছিলেন
১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে ৮ ঘণ্টা শ্রমদিনের দাবিতে আন্দোলন রত শ্রমিকের উপর গুলি চালানো হলে ১১ জন শহীদ হযন। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৯সালের ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস অর্থাৎ মে মাসের প্রথম দিনটিকে পৃথিবীর অনেক দেশে পালিত হয়। বেশ কিছু দেশে মে দিবসকে লেবার ডে হিসেবে পালন করা হয়।
দিনটি সরকারি ছুটির দিন। ২০২৩ সালের এই দিনে এসে আমরা যখন অতীতের দিকে তাকাই, আমরা দেখতে পাই আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কতটা শ্রমিক অন্তঃপ্রাণ ছিলেন। ১৯৫৭ সালের ৫ জুন শান্তি চুক্তির সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, শিল্পমালিক ও শিল্পশ্রমিকদের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করতে হবে। একপক্ষ শাসক ও অন্যপক্ষ শোষিত হলে চলবে না। আমাদের সেই প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে যখন বার্লিন যুব উৎসব হয়, তখন তিনি বলেছিলেন যে, নির্যাতিত মানুষের জাতীয় মুক্তির সঙ্গে আমরা সবাই একাত্মতা ঘোষণা করছি। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল কৃষক ও শ্রমিক তাদের স্বার্থ রক্ষা করা। এর পরে তিনি যত সম্মেলনে গিয়েছেন, তিনি সেখানে সবসময়ই একটি কথা বলেছেন, শোষিতের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা সবসময় একাত্ম আছি। কাজেই আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলি, সেটি হবে শোষিতের গণতন্ত্র, শ্রম মানুষের গণতন্ত্র। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়ে গেছেন।
শ্রমের মর্যাদা, মূল্য ও ন্যায্য মজুরি শুধু নয়, যুক্তিসঙ্গত কর্ম সময় নির্ধারণের আন্দোলনের এত বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে মানুষের সমাজ ও সভ্যতার। শ্রম ছাড়া কোনো কিছুই উৎপাদন করা যায় না-এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু, কর্ম ঘণ্টা কতক্ষণ হবে? শ্রমশক্তি বিক্রি করে যে শ্রমিক সে কি তার শ্রম সময়ের মূল্য নির্ধারণ করতে পারবে?
কতক্ষণ কাজ করলে এবং কতটুকু মূল্য পেলে তার জীবন বিকশিত করার সুযোগ সে পাবে, জীবনের চাহিদা বলতে আসলে কী বুঝায়, শ্রমের কাজে নিয়োজিত পশু এবং মানুষের ভূমিকা, মূল্য এবং মর্যাদা কীভাবে বিবেচিত হবে, জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন ও জীবন বিকাশের জন্য সংস্কৃতি নির্মাণে শ্রমের ভূমিকা কী, এ রকম অসংখ্য প্রশ্নের ঘনীভূত রূপ হিসেবে দাবি উঠেছিল ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস চাই। এই দাবির অন্তরালে ছিল আর একটি দাবি, ৮ ঘণ্টা কাজ করে এমন মজুরি চাই যেন তা দিয়ে আমার পরিবার নিয়ে মানসম্পন্ন জীবনযাপন করতে পারি। কিন্তু শ্রমিকদের দাবি যতই ন্যায়সঙ্গত মনে হোক না কেনো মুনাফা ও মজুরির সংঘাত এত তীব্র যে আলোচনার পথে নয় বরং নিষ্ঠুর দমন ও রক্তাক্ত পথে সরকার ও মালিকরা সেই আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিল।
গ্রাম থেকে উঠে এসে কারখানা-শ্রমিকে পরিণত হওয়া মানুষটি জীবন বাঁচাতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করছে। কিন্তু, তার জীবনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। অথচ মালিকদের প্রাচুর্য ও জৌলুশ বাড়ছে। শ্রমিকের সমস্যা যেহেতু সমাধান হয়নি তাই আন্দোলন ছড়িয়ে পরে দেশে দেশে।
এ রকম বহু আন্দোলন আর পরাজয়ের বেদনার মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছিলো ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের আন্দোলন।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই মে দিবস সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। মে দিবসের প্রধান দাবি ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস ২২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হলেও কোটি কোটি বেসরকারি শ্রমিক কর্মচারীরা এখনো ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের সুফল পায় না। বরং শ্রম আইনে কৌশলে ১০ ঘণ্টা কাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিম্ন মজুরির ফাঁদে শ্রমজীবী মানুষকে এমনভাবে আটকে ফেলা হয়েছে যে শ্রমিকরা এখন বাধ্য হয় ওভার টাইম করতে, তা না হলে তার সংসার চালানো অসম্ভব।
যন্ত্রের শক্তি মানুষের শ্রমকে লাঘব করবে। ফলে অল্প সময়ে বেশি উৎপাদন হবে-এই প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবে শ্রমিকের শ্রম সময় কমছে না। নারী শ্রমিকের শিল্পে আগমন বেড়েছে কিন্তু তাদের মাতৃত্ব, সংসারের কাজ নিয়ে দ্বিগুণ চাপ বহন করতে হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিশ্রম এবং একঘেঁয়ে সাংসারিক কাজ নিংড়ে নিচ্ছে নারীদের শ্রমশক্তি। দ্রুত হারিয়ে ফেলছে সে তার কাজ করার ক্ষমতা। তাই দেখা যায় যে, শিল্প কারখানায় ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারী শ্রমিক কাজ করতে পারছে না। অন্যদিকে, কারখানার উচ্চপদে বা ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বে নারী শ্রমিকদের উপস্থিতি কম। ওভার টাইম আর যন্ত্র মিলে অল্প শ্রমিক দিয়ে বেশি কাজ করানোর ফলে কর্মক্ষম যুবশক্তির একটি বড় অংশ বেকার। এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে বিশ্বব্যাপী। এর মধ্যে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের নির্বাহী প্রধান ক্লাউস শোয়াব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়েছে বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন তা এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মুনাফা এবং মজুরির যে বিরোধ-সেই বিরোধে শ্রমিক সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও দুর্বল এবং শোষিত। ফলে সারা দুনিয়াতে খাদ্যপণ্য ও ব্যবহারিক পণ্য উৎপাদন সকল রেকর্ড ভেঙে ফেললেও তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। আয়ের বড় অংশ খাদ্য, বাড়িভাড়া, পোশাক, চিকিৎসায় ব্যয় হয়ে যাওয়ার ফলে সঞ্চয় যেমন থাকছে না তেমনি দক্ষতা অর্জনের জন্য বাড়তি খরচ করাও শ্রমিকের জন্য সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাহলে ডিজিটাল দক্ষতা শ্রমিকরা অর্জন করবে কীভাবে? চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কি তাহলে বেকারত্বের ভয়াবহতা নিয়ে আবির্ভূত হবে? উৎপাদন এবং বেকারত্ব বৃদ্ধির এই দুষ্টচক্র সামাজিক সব শৃঙ্খলাকেই ভেঙে ফেলবে। উৎপাদন বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা এবং আগ্রাসী পুঁজিবাদের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস ও ন্যায্য মজুরির কোনো বিকল্প নেই। বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের পটভূমিতে মে দিবস বার বার সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। কাজেই মে দিবসে আমাদের শিক্ষা এটিই হওয়া উচিত যে, কে মালিক কে শ্রমিক এই দ্বন্দ্বে না গিয়ে উভয়কে উভয়ের পরিপুরক এটিই সবাইকে ভাবতে হবে।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: সাবেক উপাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়