বিনিয়োগ বাড়াতে অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ দরকার
আমাদের দেশে সম্প্রতি অবকাঠামো খাতে বেশ উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও যথেষ্ট দুর্বলতা আছে। আমাদের এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যয়ের হার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। অধিকাংশ অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে এবং বরাদ্দ দেওয়া ব্যয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা এখনো বিদ্যমান। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার পরিবেশ লক্ষ করা যাচ্ছে না। এ বছর শেষের দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এবারের জাতীয় নির্বাচন অত্যন্ত জটিল এবং কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে। নির্বাচন ভালোভাবে অনুষ্ঠানের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার পরিবেশ প্রয়োজন। কিন্তু এখনো সে রকম কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনৈতিক সংঘাত এবং বৈরী পরিবেশ বিনিয়োগের জন্য মোটেও অনুকূল নয়। অনেক দিন ধরেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিবেশে কোনো দেশে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহী হয় না। এমনকি স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হয় না। তাই বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নত এবং অনুকূল করতে হবে।
ব্যাংকিং সেক্টর হচ্ছে একটি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। ব্যাংকিং সেক্টরকে বলা হয় অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’। আমাদের দেশের ব্যাংকিং সেক্টর ঠিকভাবে কাজ করছে না। ব্যাংকিং সেক্টর নানা রকম সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। ব্যাংকিং সেক্টরে আমানতের প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। ব্যাংকবহির্ভূত অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ব্যাংকের বিনিয়োগযোগ্য আমানতের পরিমাণ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। ব্যাংক যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ আমানত না পায় তাহলে বিনিয়োগ করবে কীভাবে? ব্যাংক উদ্যোক্তাদের চাহিদামতো অর্থায়ন করতে পারছে না। আমাদের দেশের স্টক মার্কেট এখনো সেভাবে বিকশিত হয়নি। উদ্যোক্তারা তাদের প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য ব্যাংকের নিকটই ধরনা দেয়। স্টক মার্কেট যদি সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারত তাহলে উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন সংগ্রহের জন্য ব্যাংক নির্ভরতা কমে যেত। ব্যাংকিং খাতে অন্যান্য জটিল সমস্যাও রয়েছে। কয়েকটি ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতি আর অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা ব্যাংকিং সেক্টর সম্পর্কে আমানতকারীদের মধ্যে কিছুটা হলেও আস্থার সংকট সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এটা আমানতকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। ব্যাংকিং সেক্টরের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে নন-পারফর্মিং লোনের (এনপিএল) ব্যাপক উপস্থিতি। নানাভাবে চেষ্টা করেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে খেলাপি ঋণের যে হিসাব প্রদর্শন করা হচ্ছে তা বাস্তবসম্মত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক মামলাধীন প্রকল্পের নিকট পাওনা ঋণ, অবলোপনকৃত প্রকল্পের নিকট পাওনা ঋণ এবং পুনঃতফসিলিকৃত ঋণের হিসাব বাদ দিয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ করছে। এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। আইএমএফ এবং এ ধরনের সংস্থাগুলো বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে পরিমাণ প্রদর্শন করে প্রকৃত খেলাপি ঋণ তার দ্বিগুণেরও বেশি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু আদায়ের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমানোর কোনো উদ্যোগই সফল হচ্ছে না। ঋণ গ্রহণের সময় আবেদনকারী যে সম্পদ বন্ধক প্রদান করে তা বিক্রি করে অর্থ আদায়ের তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যে সম্পদ বন্ধক দেওয়া হয় অধিকাংশ সময়ই তার অতিমূল্যায়ন করা হয়। ফলে এসব সম্পদ ব্যাংক বিক্রি করতে গেলে উপযুক্ত মূল্য পায় না। রাজনৈতিক নেতা, ব্যাংকের স্পন্সর এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা লক্ষ করা যায়। তারা ব্যাংকিং সেক্টরের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বিঘ্নিত করছে। এরা পরস্পর যোগসাজশের মাধ্যমে ব্যাংক ঋণ নিয়ে যাচ্ছে। এই ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হচ্ছে। ফলে এসব ঋণের অর্থ ব্যাংক চাইলেও পরবর্তীতে আদায় করতে পারছে না। এদের কারণে প্রকৃত উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যায় পতিত হচ্ছেন। ঋণ প্রদানকালে যদি জামানত সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে নেওয়া হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে সেই ঋণ হিসাব খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। ব্যক্তিগতভাবে আমি দেখেছি কীভাবে বন্ধকী সম্পদের অতিমূল্যায়ন করে ঋণ গ্রহণ করা হয়। সেই ঋণ পরবর্তীতে আর আদায় হয় না।
খেলাপি ঋণ সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের সমস্যা আছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যাংকে একটি প্রকল্প সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার মতো দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে। আবার যেসব ব্যাংকে দক্ষ লোকবল আছে তাদের স্বাধীনভাবে সঠিক পদ্ধতিতে কাজ করতে দেয়া হয় না। অধিকাংশ সময়ই তারা উপরের মহল থেকে নির্দেশিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। এভাবে তাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ভালো কাজ প্রত্যাশা করা যায় না। ঋণদানের সময় যে সম্পদ বন্ধক রাখা হয় অনেক সময় তার মালিকানা ঠিক থাকে না। সম্পদের অতিমূল্যায়ন করা হয়। এখানে আমরা একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে চাই, অত্যন্ত ক্ষমতাবান এবং উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন এক ব্যক্তি ঋণের জন্য আবেদন করেন। তিনি জামানতের জন্য জমি প্রদানের প্রস্তাব করেন। ঋণ দানের আগে আমি ব্যাংক থেকে একটি টিম প্রেরণ করলাম প্রস্তাবিত জমিটি পরিদর্শন ও মূল্যায়নের জন্য।
প্রথমত, প্রস্তাবিত জমির উপর ঋণের জন্য আবেদনকারীর সঠিক মালিকানা নেই। তিনি একটি বায়নানামা সম্পাদন করেছেন মাত্র। কিন্তু বায়নানামার মাধ্যমে তো জমির মালিক হওয়া যায় না। যে জমি বায়নানামা করা হয়েছে সেটিও পানির নিচে। আমি ঋণ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি। অবশ্য আমার উপর কোনো চাপ সৃষ্টি করা হয়নি। ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু বোর্ড যদি স্বাধীনভাবে ব্যাংকের স্বার্থে কাজ না করে তাহলে কোনোভাবেই ব্যাংকের স্বার্থ সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়।
আমি মনে করি, আগামী অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে সেখানে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বাড়ানোর কাজটিই সবচেয়ে সমস্যার সৃষ্টি করবে। আমাদের নিজস্ব তহবিল থেকে উন্নয়ন কার্যক্রমে অর্থায়নের জন্য ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বাড়াতেই হবে। কিন্তু কাজটি মোটেও সহজ নয়। আপনি যদি লক্ষ করেন তাহলে দেখবেন, দেশে টিআইএন ধারীর যে সংখ্যা তার অর্ধেকও আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন না। যারা টিআইএনধারী তারা তো রিটার্ন দেবেই। এটা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এখানে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা তেমন একটা নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উচিত হবে, করের হার না বাড়িয়ে করের আওতা বৃদ্ধি করা। যারা কর প্রদানযোগ্য তাদের যেকোনো মূল্যেই হোক করের নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে আসা। যারা নিয়মিত কর প্রদান করছেন, তাদের উপর করের হার না বাড়িয়ে নতুনদের করের আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে হবে। মূল্য সংযোজন করের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পণ্য বিক্রির বিপরীতে রশিদ দেয় না। তারা গ্রাহকদের নিকট থেকে ট্যাক্স আদায় করলেও তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেন না। মূল্য সংযোজন কর আদায় ব্যবস্থা অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই প্রচেষ্টা আরও জোরদার করতে হবে। আমদানি শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্রে প্রায়শই দেখা যায়, এক পণ্য আমদানির ঘোষণা দিয়ে অন্য পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। এভাবে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। এটা রোধ করতে হবে।
এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।
এসএন