ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার
১৭ এপ্রিল ১৯৭১, মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরাকারের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য এবং আমাদের মহান মক্তিযুদ্ধকে সুগঠিত করে সুপরিকল্পিতভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এ দিনটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে শুধু গৌরবেরই নয়, বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এদিন শুধুমাত্র বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানই অনুষ্ঠিত হয়নি, এদিন শপথ অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়।
এই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন তার যেমন সাংবিধানিক স্বীকৃতি মেলে, তেমনি বঙ্গবন্ধু যে প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি তারও সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়। ১৭ এপ্রিলের আগের তারিখ ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ এ দিনটিও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অনন্য ঐতিহাসিক দিন। ঐদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করা হয় এবং যার উপর ভিত্তি করে ঐদিনই মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের এক বেতার ভাষণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাকামী বাংলাদশ রাষ্ট্রের একটি স্বাধীন সরকারের আত্মপ্রকাশ ঘটে যে সরকারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ বেতার ভাষণটি প্রথম রাত সাড়ে ৯টায় আকাশবাণীর একটি কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় এবং পরে আকাশবাণীর বিভিন্ন কেন্দ্র এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১১ এপ্রিল পুনঃপ্রচার করা হয়। এ সরকারই আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ নেয়। এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করে শোনান অধ্যাপক ইউসুফ আলী।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ঘোষণাপত্রটিই সাংবিধানিক ভিত্তি কাঠামো হিসেবে কাজ করে এবং এর আহরিত ক্ষমতাবলে সকল আদেশ ও সার্কুলার জারি করা হয় এবং সরকারের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের এই অনন্য দলিলটি পরবর্তীতে সংবিধান রচনার সময় সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। বর্তমান সংবিধানে চতুর্থ তফসিলে ১৫০(১) অনুচ্ছদ অনুযায়ী ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী হিসেবে এবং সপ্তম তফসিলে ১৫০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকরা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের (অনূদিত) উল্লেখ ও সন্নিবেশন আছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আাইন সংবিধানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অন্তর্ভূক্ত করে এবং সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকারের অভিযাত্রা একটি মাইলফলক। আর মুজিবনগর সরকার আলোচনায় এলেই বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি আর একটি নাম জীবন্ত হয়ে উঠে তা হলো- বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে ঘনিষ্ট ও বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহচর জননেতা তাজউদ্দীন আহমদের নামটি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঘুমন্ত শান্তিপ্রিয় বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নারকীয়, বর্বরোচিত ও নৃশংস গণহত্যাযঞ্জ চালায় এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষনা দেওয়ার কারণে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে গ্রেপ্তার হন। তাজউদ্দীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যেভাবেই হোক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে। শুধু তাই নয় তিনি একটি সরকার গঠনের কথা ভাবতে থাকেন যার নির্দেশনা এবং ইঙ্গিত তিনি পূর্বেই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এর স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে একটি তথ্য দেওয়া যেতে পারে তা হলো-১৯৭১ সালের ৬ ও ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদকে তৎকালীন ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনার কৈলাশ চন্দ্র (কেসি) সেনগুপ্তের কাছে পাঠিয়েছিলেন সাহায্যের আশ্বাস পেতে।
এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীনের সম্পর্ক, বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাজউদ্দীনের অগাধ শ্রদ্ধা, সংকটে ও দুর্যোগে ধীর-স্থিরসম্পন্ন মেধাবী তাজউদ্দীনের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে সহজেই অনুমেয় যে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কী করণীয় তা কেবলমাত্র তাজউদ্দীনের পক্ষেই সহজে উপলব্ধি করা সম্ভব। নিজের অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করাসহ একটি সরকার গঠন করার বিষয়টি মাথায় রেথে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড নেতৃত্বকে আত্মগোপনে যাওয়ারও নির্দেশনা ২৫ মার্চ সন্ধ্যাতেই দেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু নিজে আত্মগোপন করেননি, কারণ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা যদি ভারতের মতো জায়গায় আত্মগোপন করতেন তাহলে আগরতলা মামলা থেকে শুরু করে পাকিস্তান সরকার তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপন করে এসেছে সেটাই আন্তর্জাতিক কূটনীতিক মহলে সত্য বলে প্রমাণিত হতো।
এ ছাড়াও আত্মগোপনে না যাওয়া প্রসঙ্গে যুক্তি হিসেবে মুজিব বলেন, তাকে না পেলে আর্মিরা ঢাকা শহর ধ্বংস করে দেবে। তিনি এও বলেন, তার বাড়ির আশেপাশে গুপ্ত ঘাতকরা অবস্থান নিয়েছে, তিনি বাড়ির বাইরে গেলে তাকে হত্যা করে বামপন্থীদের ঘাড়ে এর দোষ চাপানো হবে। মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অসংখ্য কূটনৈতিক চালের মধ্যে এই চালটিও ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রখর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতারই আর একটি অনন্য উদাহরণ।
২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত বর্বরোচিত গণহত্যা বিশ্ববাসীকে জানাতে এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সরকার গঠনের কথা মাথায় রেখে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ২৭ মার্চ ঢাকা ত্যাগ করে সীমান্তের উদ্দেশে পাড়ি জমান, উদ্দেশ্য ভারত গমণ। ঢাকা থেকে গোপনে রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাগুড়া ও ঝিনাইদহ হয়ে ৩০ মার্চ দুপুরের দিকে চুয়াডাঙ্গায় আসেন এবং স্থানীয় মহকুমা প্রশাসকের খালি বাসভবনে তাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ সেখানে চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচন করেন। এদিনই তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঙালি জাতিকে রক্ষা ও স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে যথাসম্ভব দ্রুত একটা সরকার গঠন করা দরকার এবং এজন্য প্রতিবেশি গণতান্ত্রিক ভারত সরকারের সহযোগিতা আবশ্যক।
এমতাবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী (মেহেরপুরের মহকুম প্রশাসক), মাহবুব উদ্দীন (ঝিনাইদহের এসডিপিও), মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও নির্বাচিত প্রতিনিধি ডা. আসহাবুল হক ও অন্যরা পারস্পরিক আলোচনা করে ভারতের সাহায্য প্রার্থনার সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এ লক্ষে ৩০ মার্চ বিকেলেই তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও মাহবুব উদ্দীনকে সঙ্গে নিয়ে জীবননগর হয়ে কুষ্টিয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হন।
চুয়াডাঙ্গা সীমান্তপথে ভারত যাওয়ার বিবরণ দিতে গিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম লিখেছেন- “তাজউদ্দীন ভাই ও আমি চুয়াডাঙ্গা থেকে সীমান্তের পথে রওনা হই। তৌফিক ও মাহাবুব আমাদের সঙ্গে ছিল। আমরা পলায়নী মনোবৃত্তি নিয়ে সীমান্ত পার না হয়ে স্বাধীন দেশের স্বাধীন সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ্য মর্যাদা নিয়েই ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। স্বাধীন দেশের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করলেই কেবল প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের আলোচনা সম্ভব।”
সীমান্তে পৌঁছে তাই ‘উঁচু পর্যায়ের দুজন আওয়ামী লীগ নেতার আগমন’ সংবাদ বহনকারী হিসেবে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও মাহবুব উদ্দীনকে ভারতীয় চেকপোস্টে প্রেরণ করা হয় মূলত ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মনোভাব জানার জন্য। এদুজন সীমান্তে গিয়ে বিএসএফ কার্যালয়ে উচু পর্যায়ের দুজন আওয়ামী লীগ নেতা (প্রকৃত পরিচয় না জানিয়ে) ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান এই বিষয়টি অবহিত করেন। স্থানীয় কমান্ডিং অফিসার একজন মেজর ও কয়েকজন জোয়ান পাঠিয়ে সসম্মানে আগন্তুক দুজনকে ভারত ভূখণ্ডে নিয়ে যান। অল্প সময়ের মধ্যে ভারতীয় বিএসএফ এর আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার এসে হাজির হন এবং যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন পূর্বক তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে নিয়ে যান। গোলক মজুমদারকে প্রাথমিক পরিচয় দেওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমদ অনুরোধ জানান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনতিবিলম্বে একটি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার; যা পরবর্তীতে বিএসএফ-এর তত্ত্বাবধানে করা হয়েছিল ।
প্রকৃতপক্ষেই তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এদুজনকে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করে। ৩০ মার্চ রাতেই তারা প্রথমে কৃষ্ণনগরে পৌঁছান এবং সেখান থেকে কলকাতা যান। এরপর বিশেষ প্রটোকল ব্যবস্থায় গালক মজুমদার নিজে গাড়ি চালিয়ে তাদের দমদম এয়ারপোর্টে নিয়ে যান। সেখানে মধ্যরাত নাগাদ তারা নেহেরু পরিবারের ঘনিষ্ঠ স্বয়ং বিএসএফ প্রধান রুস্তমজীকে বিমান থেকে অবতরণ করতে দেখতে পান। দমদম এয়ারপোর্টে তাজউদ্দীন ও রুস্তমজীর সাক্ষাৎ হবার পর তাদের নিয়ে গিয়ে সুরক্ষিত ‘আসাম ভবনে’ রাখা হয়। সেখানে প্রায় তারা সারা রাত ধরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ও নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনাক্রমে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা এবং সে সম্পর্কিত পরিকল্পনার কাজ এগিয়ে নেন। এরপর কেএফ রুস্তমজী দিল্লির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হয় এদুজন নেতাকে দিল্লি নিয়ে যাওয়ার জন্য।
অবশেষে ১ এপ্রিল দিবাগত রাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে গোলক মজুমদারেরর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে বিএসএফ-এর ব্যবস্থাপনায় সামরিক রসদবাহী একটি বিমানে করে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়। দিল্লিতে যাওয়ার পর ভারত সরকার প্রথমে বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হন যে, তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী। গোলক মজুমদার ও রুস্তমজীর প্রচেষ্টায় তাজউদ্দীন আহমদ ও ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায়। সাক্ষাতের তারিখের বিষয়ে কোনো কোনো গবেষক তাদের বইয়ে বা লেখায় ৩ এপ্রিল সন্ধ্যার কথা উল্লেখ করলেও ব্যরিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম-এর লেখা ও বক্তৃতা থেকে জানা যায় তারিখটি ৪ এপ্রিল।
এ সাক্ষাত যে দুই দফায় হয়েছে তারও উল্লেখ পাওয়া যায় তার লেখা ও বক্তৃতা থেকে । ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের আগের দিন এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাজউদ্দীন আহমদকে জিজ্ঞাসা করে যে ইতোমধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো সরকার গঠন করা হয়েছে কি না এবং তিনি কোন পদাধিকারী ব্যক্তি হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এমতাবস্থায় তিনি ত্বরিত সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ভারত সরকারকে জানাবেন ২৫-২৬ মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার গঠন করেছেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমান সেই সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং আওয়ামী লীগের হাই কমান্ডের সদস্যরা মন্ত্রীসভার সদস্য। অনেক দ্বিধা-দ্ব্ন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও দেশের স্বার্থে তাজউদ্দীন আরও সিদ্ধান্ত নেন যে, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই সাক্ষাৎ করবেন।
৪ এপ্রিলের সাক্ষাতে প্রাথমিক সম্ভাষণ বিনিময়ের পর ইন্দিরা গান্ধী প্রথম প্রশ্ন করেন “How is Sheikh Mujib? Is he all right?” তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে জবাব দেন এ বলে যে, শেখ মুজিব তাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন, তার বিশ্বাস মুজিব কোনো গোপন স্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশ দিচ্ছেন। তবে ২৫ মার্চের রাতের পর থেকে মুজিবের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। এ সাক্ষাৎকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিকট তাজউদ্দীন আহমদ সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দেশ ত্যাগ করে যারা ভারতে প্রবেশ করেছে তাদের শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ, ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার অনুমতি প্রদান, মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও সামরিক রসদ সরবরাহ ইত্যাদি। দ্বিতীয় দিন ৫ এপ্রিল আবারও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাজউদ্দীনের আলোচনা হয়।
এসব আলাচনায় তাজউদ্দীনের প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক আচরণ ও দূরদর্শিতা ইন্দিরা গান্ধীর মনোযোগ আকর্ষণ করে। দ্বিতীয় দিনের আলোচনায় প্রার্থিত বিষয়ে ভারত সরকারের সহানুভূতি সঞ্চারিত হয় এবং সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া যায়। দিল্লিতে এসময় অবস্থান করছিলেন ড. রেহমান সোবহান, ড. আনিসুর রহমান, এম.আর. সিদ্দিকী, সিরাজুল হক বাচ্চু মিয়া ও যুবনেতা আব্দুর রউফ প্রমুখ। তাদের সকলের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে তাজউদ্দীন আহমেদ ও ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলামের বৈঠক হয়। যুবনেতা আব্দুর রউফ একটি সরকার গঠনের জন্য তাদের নিকট অনুরোধ জানান। বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকেও সরকার গঠনের অব্যাহত চাপ আসছে। তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লিতে গিয়ে কেবল মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতার বিষয়টি নিশ্চিত করেননি, তিনি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে একটি সরকার গঠনের প্রায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কলকাতায় ফিরে আসেন। এখানে উল্লেখ্য যে, দিল্লিতেই তাজউদ্দীন আহমদ, রেহমান সোবহান ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম মিলে সরকার গঠনের একটি ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করেন এবং তাজউদ্দীনের কণ্ঠে দিল্লিতে বসেই সরকার গঠন সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ রেকর্ড করা হয়।
তাজউদ্দীন আহমদ কোন পরিস্থিতিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎপূর্বক সরকার গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং এ অবস্থায় কী করণীয় সে বিষয়ে আলোচনার জন্য ৮ এপ্রিল কলকাতার ভবানীপুরে একটি বাড়িতে বাংলাদেশ থেকে আগত নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন এবং এ বৈঠকে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি মন্ত্রিসভা গঠনের বিরোধিতা করে বিপ্লবী কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব রেখে বক্তব্য রাখলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে। এসময় তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম সরকার গঠনের সুদৃঢ় যৌক্তিকতা তুলে ধরে বক্তব্য রাখলে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে বিশেষত এএইচএম কামারুজ্জামানের হস্তক্ষেপে মিজানুর রহমান চৌধুরী ও শেখ ফজলুল হক মণি ব্যতিত অন্যরা সরকার গঠনের যৌক্তিকতা মেনে নেন।
১০ এপ্রিল মন্ত্রিসভার সম্ভাব্য সদস্য ও বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতাদের খোঁজখবর সংগ্রহ এবং সরকার গঠনের ঘোষণার জন্য তাজউদ্দীন আহমদ একটি রাশিয়ান ডকেটো বিমানে করে সীমান্ত এলাকায় উড়ে চলেন। সঙ্গে ছিলেন- ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমদ ও নগেন্দ্র সিংহ। মালদহ, বালুরঘাট, শিলিগুড়ি, শিলচর ও আগরতলা প্রভৃতি স্থানে বিমান থেকে নেমে বিভিন্ন আওয়ামী লীগ নেতাদের সংগ্রহ ও খোঁজখবর করে তাজউদ্দীন দুপুরে পৌঁছেন বাগডোরা বিমানবন্দরে। সেখান থেকে জিপে করে তিনি শিলিগুড়ি পৌঁছেন। পূর্ব নির্ধারিত সিন্ধান্ত মোতাবেক শিলিগুড়িতে অবস্থিত একটি রেডিও স্টেশন থেকে তাজউদ্দীন আহমদের রেকর্ডকৃত ভাষণটি প্রচার করার ব্যবস্থা করা হয়। ওই রাতে সাড়ে ৯টায় তাজউদ্দীন আহমদের কণ্ঠে বাংলাদেশ সরকার গঠন সংক্রান্ত ভাষণটি আকাশবাণীর একটি কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা (১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত ১৬৭ জন এমএনএ) আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করার মাধ্যমে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ঘোষণাপূর্বক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতোপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে একটি বৈধ সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার প্রক্রিয়া শুরু করে।
এই ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক তাদের প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদ গঠন করে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করলেন এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতোপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হলো। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ তারিখে কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে।
একটি জিনিস আমাদের মনে রাখা দরকার তা হলো- বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা যুদ্ধে বিজয় লাভ করি এবং ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেস্বর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রবর্তিত হয়। ফলে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে সংবিধান প্রবর্তিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হতে আহরিত বা আহরিত বলে বিবেচিত কর্তৃত্বের অধীনে যেমন আইন প্রণীত হয়েছে তেমনি ক্ষমতা প্রযুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রই এ সময়কালে ছিল আইন প্রণয়ন ও ক্ষমতার উৎস।
এজন্যই সংবিধান প্রণিত হওয়ার শুরু থেকেই সংবিধানের অন্য যেকোনো বিধান সত্ত্বেও চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত বিধানাবলী ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানবলী হিসেবে বিবেচিত হবে। চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানবলী সংক্রান্ত ১৫০ অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ ৩(১) অনুযায়ী বলা হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে এই সংবিধান প্রবর্তনের তারিখের মধ্যে প্রণীত বা প্রণীত বলে বিবেচিত সকল আইন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা যেকোনো আইন হতে আহরিত বা আহরিত বলে বিবেচিত কর্তৃত্বের অধীন অনুরূপ মেয়াদের মধ্যে প্রযুক্ত সকল ক্ষমতা বা কৃত সকল কার্য এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হলো এবং তা আইনানুযায়ী যথার্থভাবে প্রণীত, প্রযুক্ত ও কৃত হয়েছে বলে ঘোষিত হলো।
১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল আগরতলায় কর্নেল ওসমানীকে পেয়ে তাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির পদ গ্রহণের আমন্ত্রন জানালে তিনি তাতে সম্মতি দেন। পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে এই সরকারের শপথ অনষ্ঠানের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় তা সম্পন্ন করার একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী করার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ১৩ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় হামলা চালায়। এতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি বিলম্বিত হয়। পরবর্তীতে কবে কোথায় হবে তা গোপন রেখে সরকারেরর শপথ গ্রহণের অন্যান্য সকল প্রস্ততি সম্পন্ন করার দিকে জোর দেওয়া হয়।
প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে অবশেষে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সকাল ১১টায় পূর্ব নির্ধারিত স্থান মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা নামক বৃক্ষরাজি ঢাকা ছায়াসুনিবিড় একটি গ্রামে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। শপথ গ্রহল অনুষ্ঠানের জায়গাটির নাম শপথ গ্রহণের আগের দিনও সাংবাদিকদের নিকট অজানা ছিল। মুক্ত আকাশের নিচে চৌকি পেতে করা হয়েছিল শপথ মঞ্চ। মঞ্চের উপর সাজানো ছিল ছয়খানা চেয়ার। শপথ অনুষ্ঠানের প্রবেশ পথে বাংলা লেখা স্বাগতম। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রীসভার শপথ পাঠ করানোর পর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। এই সরকারোর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তাজউদ্দীন আহমদ এবং মন্ত্রিসভায় সদস্য হিসেবে শপথ নেন এম. মনসুর আলী (অর্থমন্ত্রী), এএইচএম কামারুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী) এবং খন্দকার মোশতাক আহমদ (পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী)। মুক্তিযুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে শপথগ্রহণ শেষে তাজউদ্দীন আহমেদ বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করেন মুজিবনগর। তখন থেকে সরকারেরও নামকরণ হয়ে যায় মুজিবনগর সরকার। এই সরকারের আধীনেই সফলভাবে আমাদের মক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি বিজয়ের স্বাদ পায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল বাংলাদেশের রাজধানী।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহচর তাজউদ্দীন আহমদ
এভাবেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকার একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে যুক্ত হয়। সেই সঙ্গে এটাও চিরসত্য ও প্রতিষ্ঠিত যে মুজিবনগর সরকারই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সরকার এবং বাঙালি জাতির পিতা ও আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি। যতদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বাংলাদেশ থাকবে ও মুক্তিযুদ্ধের নির্ভেজাল ইতিহাস উচ্চারিত হবে ততদিন মুজিবনগর সরকার আমাদের মুক্তিসংগ্রামের একটি আলোকিত অধ্যায় হিসেবে বাঙালির অন্তরে বেঁচে থাকবে।
ড. মো. হাসিবুল আলম প্রধান: সভাপতি ও অধ্যাপক, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
এসএন