নতুন প্রজন্মের ভেতর নববর্ষের উপলব্ধি জাগাতে হবে
পহেলা বৈশাখ হচ্ছে বাংলা বছরের প্রথম দিন। বাঙালি জাতির জন্য এটি একটি গৌরবের বিষয়। পৃথিবীতে কয়েকটি জাতিরই নিজস্ব পঞ্জিকা আছে। বঙ্গাব্দ এটি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ। সেকারণেই পহেলা বৈশাখ দিনটিকে আমরা উৎসবের সঙ্গে পালন করি।
সারাবছর কিন্তু আমরা বাংলা মাস অর্থাৎ বাংলা পঞ্জিকার কথা ভুলে যাই। শুধু পহেলা বৈশাখেই আমাদের মনে হয় একটি বাংলা ক্যালেন্ডার আছে এবং এই যে শুধুমাত্র আমরা একটি পহেলা বৈশাখ কেন্দ্রিক উৎসব পালন করি আর পুরো বছর বাংলা ক্যালেন্ডারকে ভুলে থাকি— এটিতে মনে হয় যে আমরা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ইত্যাদি হারিয়ে ফেলেছি। অতি সম্প্রতি ইতালিতে ইংরেজি ভাষা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ তারা দেখতে পাচ্ছে তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলাম, আমি তখন একটি প্রজ্ঞাপণ জারি করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্রছাত্রী, সকল কর্মকর্তা কর্মচারিদের অবহিত করেছিলাম যে, এখন থেকে চিঠিপত্রে বাংলা সন তারিখ উল্লেখ করতে হবে এবং আমরা সরকারিভাবেও দেখি যে, চিঠিপত্রে বাংলা সন তারিখ উল্লেখ করা হয়। এটুকুই মনে হয় যে, বাংলা সালের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা।
তা ছাড়া দেখা যায়, গ্রামীণ সমাজে বাংলা সন তারিখ মানুষ মনে করলেও আমরা যারা শহরবাসি, নিজেদের শিক্ষিত বলে দাবি করি, আমরা সারা বছরই ইংরেজি ক্যলেন্ডারের সাথে যুক্ত হই। আমাদের জন্মদিনগুলিও পালন করি অথবা মৃত্যবার্ষিকী পালন করি ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী। একারণেই পহেলা বৈশাখের কথা বলতে গিয়ে যেটি চিন্তায় আসে, যে এটি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির উৎস থেকে দূরে সরে যাচ্ছি কি না। শিশুদের ভেতর উপলব্ধি জাগ্রত করতে হবে বাংলাভাষাকে আত্মস্থ করার জন্য।
পহেলা বৈশাখের যে বড় উৎসব তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ কর্তৃক আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রায় মঙ্গল কামনা করা সেটি শুধুমাত্র বাঙালি জাতির জন্য নয়—সারা পৃথিবীর মানুষের মঙ্গল কামনা করে এবং তারিখটি হচ্ছে পহেলা বৈশাখ।
পহেলা বৈশাখে সারা পৃথিবীর মানুষের মঙ্গল কামনা করার যে গুরুত্ব— সেটি ইউনেস্কো সঠিকভাবেই উপলব্ধি করেছে। দেশের মঙ্গল প্রবাসের মঙ্গলসহ আমাদের প্রত্যেকের মঙ্গল কামনা করে বিভিন্ন রকম ব্যানার ফেস্টুন কার্টুন সজ্জিত একটি বর্নাঢ্য শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় এবং বর্নাঢ্য শোভাযাত্রার অনুকরণে দেশের বিভিন্ন জেলায় তরুণ প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা করে চলেছে।
যত দিন যাবে আমরা দেখতে পাব মঙ্গল শোভাযাত্রার অংশগ্রহণ আরও বাড়তে থাকবে। পহেলা বৈশাখের আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির অনুষঙ্গ আমরা শহরেও অনুসরণ করছি অর্থাৎ পান্তা ইলিশ খাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো আছে। গ্রামীণ সমাজে পান্তা ভাত বহু প্রাচীন একটি ঐতিহ্য। ভাতের মধ্যে পানি দিয়ে রাখলে ভাত নষ্ট হয় না। এই পদ্ধতিতে তারা ভাত সংরক্ষণ করেছে এবং পরদিন সকালে ভাত খেয়েছে। অনেকেই সেভাবে হয়তো জীবন যাপন করেন। যদিও গ্রাম এখন ধাপে ধাপে শহরে পরিণত হচ্ছে, গ্রামে বিদ্যুৎ গেছে। গ্রামের বহু বাড়িতেই এখন রেফ্রিজারেটর ফ্রিজ আছে। আমাদের পহেলা বৈশাখও কিন্তু গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ। একসময় হয়ত আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলব। সময়ের বিবর্তনে অনেককিছুর পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু আদি সংস্কৃতি ঐতিহ্য ইত্যাদি যেন জীবন থেকে হারিয়ে না যায়। সেকারণেই কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রাকে স্থান দেওয়া হয়েছে।
একবিংশ শতাব্দীর মানুষ হিসেবে আমরা যে উৎসব আয়োজনে অংশগ্রহণ করছি, সেই সংস্কৃতি আমাদের বহু আগে থেকেই ছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন, বাঙালি জাতির যে সম্পদ আছে, যে ঐতিহ্য আছে, তা নিয়েও আমাদের গৌরবের অনেক কিছু আছে। সেই গৌরব নিয়ে দেদীপ্যমান থাকব। পহেলা বৈশাখে গানের অনুষ্ঠান হয়। আমরা ছায়ানটে গানের আসরের আয়োজন করি। রমনার বটমূলে এই যে বৈশাখী আয়োজনে অসংখ্য মানুষের সমাগম দেখেই আমরা বুঝতে পারি বাঙালি জাতির ঐতিহ্যময় আয়োজনটি আমাদের কত প্রিয় এবং শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় এই আয়োজন থাকে। নতুন বছরের শুরুতে এই আনন্দ আয়োজন কিন্তু আমাদের সারা বছরই শক্তি যোগায়। এ সকলই আমাদের সুসংস্কৃতিবান হতে সাহায্য করে। আমার কথা হচ্ছে, পহেলা বৈশাখের চেতনাটি যেন আমরা সারা বছরই ধারণ করতে পারি। এই হোক আমাদের পহেলা বৈশাখের প্রত্যাশা ও অঙ্গীকার।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরএ/