ডা. জাফরুল্লাহর জীবন মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রজীবন থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলেন। অন্যায়কারী কতটা শক্তিশালী, তার বিরুদ্ধে কথা বললে অসুবিধা হবে কি না—এ সব বিবেচনা উনার মধ্যে ছিল না। আমরা অল্প বয়স থেকেই সেটি দেখেছি।
মেডিক্যাল কলেজে থাকাকালীন থেকেই তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য যখন লন্ডনে গেছেন, মেডিক্যাল সাইন্সের পড়াশোনা করেছেন, শুধুমাত্র ব্যবসায়িক ডাক্তার হওয়া, পশ্চিমে মেডিক্যাল সাইন্স যেভাবে পড়ানো হয়, তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা ইত্যাদি ব্যাপারগুলো ডা. জাফরুল্লাহর মধ্যে ছিল না। গণস্বাস্থ্যের যে মৌলিক বিষয়গুলো যেমন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত তিনি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন। বিশেষ করে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি যেভাবে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন শিক্ষিত গণমুখী মানুষদের একজন ছিলেন। সেটিরই ধারাবাহিকতা আমরা গত পাঁচ দশকে দেখেছি। একটি ভিন্ন ধারার স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে মানুষের কাছে পরিচিত করা, সেটির জন্য পত্রিকা বের করা, প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, হাসপাতাল তৈরি করা, ইত্যাদি কাজগুলো তিনি করেছেন। তার এই প্রচেষ্টা দেশ ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৮১ সালে। আমি তখন বিচিত্রাতে একটি সিরিজ লিখছিলাম। তারই একটি পর্ব ছিল ঔষধে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। তখন তার সঙ্গে পরিচয় ও নানা বিষয়ে কথাবার্তা হয়।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করতে চাইতেন সহজভাবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবার জন্য সব ক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রিধারী বা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসকের দরকার নেই। স্বল্প শিক্ষিত মানুষকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়েও সেবা পাওয়া সম্ভব। তার হাত ধরেই বাংলাদেশে প্রথম স্বাস্থ্যবিমা চালু হয়। জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার কোনো উদ্যোগকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, গণস্বাস্থ্যের মাধ্যমে গড়ে তোলা সফল স্বাস্থ্য উদ্যোগ সরকারই যেন সারাদেশে প্রয়োগ করে বা ছড়িয়ে দেয়।
স্বাধীনতার পর দেশের ওষুধের বাজারে বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। তখন বাজারে চার হাজার ধরনের ওষুধ ছিল। এর প্রায় সবই বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। ওষুধ ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। জাতীয় ওষুধনীতি দেশি কোম্পানিগুলোকে ওষুধ উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করে দেয়, পাশাপাশি দেশে তৈরি হওয়া ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা বন্ধ হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ একটি ওষুধ রপ্তানিকারক দেশ। দেশের মানুষকে স্বল্প মূল্যে ওষুধ দেওয়ার জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ওষুধ কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা করে।
বৈশ্বিকভাবে বিকল্প স্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভূমিকা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবছর ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি আয়োজন করে। এর বিকল্প হিসেবে কয়েক বছর পরপর আয়োজন করা হয় পাবলিক হেলথ অ্যাসেম্বলি বা জনগণের স্বাস্থ্য সম্মেলন। এটা আয়োজন করে পিপলস হেলথ মুভমেন্ট নামের একটি বৈশ্বিক সংগঠন। এই সংগঠনের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জীবনের নানা পর্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার বা সম্মাননা পেয়েছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ১৯৭৭ সালে তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয় সরকার। ফিলিপাইনের র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে। ১৯৯২ সালে সুইডেন থেকে তাকে দেওয়া হয় রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড। কানাডার ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব ন্যাচারাল মেডিসিন ২০০৯ সালে দেয় ডক্টর অব হিউম্যানিটেরিয়ান উপাধি। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলে থেকে ২০১০ সালে দেওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ অ্যাওয়ার্ড। যুক্তরাজ্যের প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন ভয়েস ফর গ্লোবাল বাংলাদেশিজ ২০২২ সালে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে ‘এনআরবি লিবারেশন ওয়ার হিরো ১৯৭১’পুরস্কার দেয়।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি একজন জীবন্ত মানুষ হিসেবেই আমাদের মাঝে ছিলেন। কখনো নিজেকে প্রত্যাহার করেননি। নতজানু হননি এবং নিজেকে আত্মসমর্পণ করেননি অথবা নীরব হননি। তার এই সরবতা জীবনের শেষ দিন অব্ধি ছিল। এটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করে এবং তার এই পুরো জীবনটাই একটি অনুপ্রেরণার উৎস।
আনু মুহাম্মদ: শিক্ষাবিদ
আরএ/