মানবাধিকার প্রতিশ্রুতির বাস্তব রূপদান জরুরি
মানবাধিকারের মধুর বাণী উচ্চারণ খুব সহজ। কিন্তু পথে-প্রান্তরে ঘুরে সাধারণ মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা পাহাড় সরানোর সমান। ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি হওয়া আইনি-রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিপরীতে মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবে রূপ দেওয়া কঠিন কাজ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য প্রচারের একটি সংঘবদ্ধ চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের র্যাব এবং এই প্রতিষ্ঠানের সাবেক ও তৎকালীন কর্মরত ঊর্ধ্বতন সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) আরোপ করে। এরই সূত্র ধরে ১০ ডিসেম্বর কিছু ভুঁইফোড় সংগঠনের উদ্যোগে লন্ডনে একটি র্যালির আয়োজন করা হয়েছে। এ উপলক্ষে সম্প্রতি ‘হিউম্যান রাইটস ডে র্যালি: হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ-এ ক্রাই ফর হেল্প’ শিরোনামে ইংরেজিতে একটি লিফলেট প্রকাশিত হয়েছে। এতে আয়োজকেরা দাবি করেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে স্যাংশন দেওয়া হোক। তারা লিখেছেন, ‘স্যাংশন হাসিনা অ্যান্ড হার ডেথ স্কোয়াড’। এই লিফলেটে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে ভয়াবহ অসত্য তথ্য প্রচার করা হয়েছে। অবশ্য এতে তারা একটি সত্য তথ্য তুলে ধরেছেন। সত্য কথাটি হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন আরোপ করেছে। যা হোক, আয়োজকেরা তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে লিফলেটটিতে ব্যক্ত করেছেন। তারা পুরো সরকারের বিরুদ্ধে স্যাংশন চান। তাদের এই কর্মকাণ্ড থেকে এটি প্রতীয়মান হচ্ছে, বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের সুরে তারা কথা বলছেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত দোষীদের অপরাধের বিচার চলমান রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে সাজা দেওয়া হচ্ছে। এই আদালতের রায়ে কোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে আপিল করার বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ১৯৭৩ সালের আইনে রাষ্ট্রপক্ষের জন্য প্রতিবন্ধকতা ছিল। ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা অসম সুযোগ পেতেন। মূল আইনে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের অধিকার ছিল না। ফলে ২০১৩ সালে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন শাস্তি দেওয়া হলে শাহবাগ চত্বরে এই বিধানের বিপক্ষে আন্দোলন হয়। তখন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ জনদাবির মুখে ১৯৭৩ সালের আইনটি সংশোধন করে। অথচ এই লিফলেটে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার কার্যক্রমকে ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এটা স্পষ্টভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দেশে ও বিদেশে যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, লিফলেট প্রচারকারীরা তাদেরই অংশ। শাহবাগ চত্বরে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের আন্দোলনকে বানচাল করে দিতে দেশজুড়ে তাণ্ডব শুরু করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলামী। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার নেমে আসে, ক্ষুণ্ন হয় তাদের মানবাধিকার। অথচ লন্ডন থেকে প্রকাশিত লিফলেটে শাপলা চত্বর ম্যাসাকার, বগুড়া ম্যাসাকার এবং সাতক্ষীরা ম্যাসাকারের নামে তিনটি মনগড়া নারকীয় হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে তৎকালীন বিরোধী দলের সরকার উচ্ছেদের রাজনীতি এবং পরে বিরোধী দলের সংখ্যাতত্ত্বের রাজনীতি মানবাধিকারের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের চেয়ে ক্ষমতার প্রতি তাদের মোহকে স্পষ্ট করে তোলে।
বাংলাদেশে আইনের শাসনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের আরও কাজ করতে হবে। ধনী-গরিব কিংবা ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাহীন আইনের দৃষ্টিতে সমান, আদালতে উভয়ের গুরুত্ব একই রকম হওয়া উচিত। প্রত্যেকের মানবিক মর্যাদা রক্ষা করা বিচারকের কাজ। যদিও সব ক্ষেত্রে তা হয় না। কিন্তু তাই বলে কি যখন হয় তখনো এর বিরোধিতা করতে হবে? খালেদা জিয়া একটি বড় রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন হওয়ায় তিনি আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবেন? আদালত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার করে তাকে শাস্তি দিয়েছেন। তারপরও বয়স ও স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে সরকার তাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়েছে। সময়ে সময়ে প্যারোলের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
বিদেশে বসে মানবাধিকারের মধুর বাণী উচ্চারণ খুব সহজ। কিন্তু পথে-প্রান্তরে ঘুরে সাধারণ মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা পাহাড় সরানোর সমান। ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি হওয়া আইনি-রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিপরীতে মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবে রূপ দেওয়া কঠিন কাজ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বীর জনগণ মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম যে এ দেশে আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করব।
আমরা সব ক্ষেত্রে সফল হতে পারিনি, কিন্তু লড়াই জারি রয়েছে। এ লড়াই একান্তই আমাদের নিজস্ব লড়াই। এ ক্ষেত্রে কোনো বিদেশি স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী মানবাধিকারের ছদ্মবেশে রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকাণ্ড আমাদের আশাহত করতে পারবে না। মানবাধিকারের পক্ষে আমাদের সংগ্রাম চলবেই!
ঘৃণা ছড়ানোর অধিকার পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই কোনো নাগরিককে দেয়নি। ঠিক একইভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলেও কোনো ব্যক্তিকে এই অধিকার দেওয়া হয়নি। কিন্তু লন্ডনে বসে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের অপব্যবহার করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে।
বিশ্বের বিবেকবান মানুষেরা এসব কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন না। তা ছাড়া, অসত্য তথ্য ব্যবহার করে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্যাংশনের দাবি করে প্রচারণা চালানোর আর যা-ই উদ্দেশ্য থাক, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা যে তাদের উদ্দেশ্য নয়-এ কথা বলা বাহুল্য। বিদেশে বসে দেশের বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য ছড়ানো এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করাটা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকের পক্ষে সম্ভব নয়।
ইতিবাচক নানা সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারির সময়ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। করোনা মোকাবিলায় আমরা উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় ভালো করেছি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে যেখানে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে, সেখানে বর্তমান সরকার দারুণ সফলতা লাভ করেছে। একই সঙ্গে এ কথাও মাথায় রাখতে হবে যে স্বাস্থ্যসেবা নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার নয়। সচেতন নাগরিক ও মানবাধিকারকর্মী সবার দাবি হওয়া উচিত, স্বাস্থ্য অধিকারকে সংবিধানে বলবৎযোগ্য অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। পাশাপাশি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের পরিধিও বিস্তৃত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। তবে বিরোধী দলগুলো এবং নাগরিক সমাজেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন