স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অনন্য দলিল
১০ এপ্রিল, ১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অনন্য ঐতিহাসিক দিন। ওই দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করা হয় এবং যার উপর ভিত্তি করে ওই দিনই মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের এক বেতার ভাষণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি স্বাধীন সরকারের আত্মপ্রকাশ ঘটে; যার রাষ্ট্রপতি হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এ বেতার ভাষণটি প্রথম রাত সাড়ে ৯টায় আকাশবাণীর একটি কেন্দ্র থেকে প্রচার হয় এবং পরে আকাশবাণীর বিভিন্ন কেন্দ্র এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১১ এপ্রিল পুনঃপ্রচার করা হয়। এ সরকারই আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ নেয়। এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করে শোনান অধ্যাপক ইউসুফ আলী। মুক্তিযুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে এবং শেখ মুজিবের আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে শপথগ্রহণ শেষে তাজউদ্দিন আহমেদ বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করেন মুজিবনগর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘোষণাপত্রটিই সাংবিধানিক ভিত্তি কাঠামো হিসেবে কাজ করে। মুক্তিযুদ্ধের এই অনন্য দলিল পরবর্তীতে সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতোপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করার মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে একটি বৈধ সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার প্রক্রিয়া শুরু করে এবং ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগরে সমবেত হয়ে শপথ গ্রহণ করেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রীসভার শপথ পাঠ করানোর পর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। অষ্টম সংশোধনী মামলায় আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ ৪১ ডিএলআর ১৯৮৯ (এডি) ১৬৫, মুজিবনগর সরকার কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে বাংলাদেশ সুগ্রিম কোর্ট সংবিধানের মূল সূচনা (Genesis of the constitution) হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অভিবাদন গ্রহণ করছেন।
সংবিধান প্রণিত হওয়ার শুরু থেকেই সংবিধানের অন্য যেকোনো বিধান সত্ত্বেও চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত বিধানাবলী ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানবলী হিসেবে বিবেচিত হবে। চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানবলী সংক্রান্ত ১৫০ অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ ৩(১) অনুযায়ী বলা হয় যে, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে এই সংবিধান প্রবর্তনের তারিখের মধ্যে প্রণীত বা প্রণীত বলে বিবেচিত সকল আইন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা যেকোনো আইন হতে আহরিত বা আহরিত বলে বিবেচিত কর্তৃত্বের অধীন অনুরূপ মেয়াদের মধ্যে প্রযুক্ত সকল ক্ষমতা বা কৃত সকল কার্য এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হলো এবং তা আইনানুযায়ী যথার্থভাবে প্রণীত, প্রযুক্ত ও কৃত হয়েছে বলে ঘোষিত হলো।’
অর্থাৎ সংবিধানের শুরু থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য মৌলিক অংশ। সংবিধানের পরিশিষ্ট-১ এর মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি (অনূদিত) সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত আছে সংবিধানের শুরু থেকেই। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ইংরেজিতে প্রণিত ‘proclamation of independence’ যা মুজিবনগরে ঘোষিত ও জারিকৃত তা ২৩ মে ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। শুধু তাই নয়, বিএনপি সরকারের সময় যে সংবিধান অনুসরণ করা হয়েছে সেখানেও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য মৌলিক অংশ হিসেবেই বলবৎ ছিল।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন-২০১১ এর ৫০ ধারা বলে ১৫০ অনুচ্ছেদটিকে নতুনভাবে প্রতিস্থাপিত করে এবং যেটি এখন পরিবর্তিতরূপে বর্তমান সংবিধানে বহাল রয়েছে। বর্তমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০(১) এ বলা হয়েছে যে, এই সংবিধানের অন্য কোনো বিধান সত্ত্বেও ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে এই সংবিধান প্রবর্তনকালে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত বিধানাবলী ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী হিসেবে কার্যকর থাকবে।
সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ হতে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই সংবিধান প্রবর্তিত হওয়ার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, ষষ্ঠ তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিগ্রাম এবং সপ্তম তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ভাষণ ও দলিল, যা উক্ত সময়ের জন্য ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী হিসেবে কার্যকর হবে। সংবিধানের এই সংশোধন অনুযায়ী বর্তমান সংবিধানে চতুর্থ তফসিলে ১৫০(১) অনুচ্ছদ অনুযায়ী ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী এবং সপ্তম তফসিলে ১৫০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের (অনূদিত) সন্নিবেশিত আছে। সংবিধানের সপ্তম তফসিলে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে।
তাজউদ্দিন আহমদের মৌলিক কিছু নির্দেশনার ভিত্তিতে ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি রচনা করেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারির মাধ্যমে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ এবং একটি সরকার গঠনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিবেচনা করে তাজউদ্দিন আহমদ তা কোনো একজন খ্যাতিসম্পন্ন আইনবিদকে দিয়ে দেখিয়ে নিতে বলেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি কলকাতার প্রখ্যাত ব্যারিস্টার সুব্রত রায় চৌধুরীকে দেখালে তিনি এটিকে যথার্থ ও অপরিবর্তনীয় বলে উল্লেখ করেন। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৭৭৪ সালে আমেরিকায় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এক ধরনের বৈপ্লবিক আন্দোলনের পরিবেশ সৃষ্টি হলে ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই ‘Declaration of Independence’ নামে সনদ ঘোষণার মাধ্যমে তা পূর্ণতা পায়।
আমেরিকার স্বাধীনতার সনদ ঘোষণার পর বাংলাদেশ ব্যতিত আর কোথাও অনুরূপ ঘোষণা প্রদানের মাধ্যমে একটি বৈধ সরকার গঠন করে স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা দেখা যায় না। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেই বলা হয় কোনো ক্ষমতাবলে এবং পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সনের ২৬ মে মার্চ তারিখে ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন, কোনো ক্ষমতাবলে একটি গণপরিষদ গঠন করে বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতোপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হলো তাও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেই উল্লিখিত আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি তারও উল্লেখ রয়েছে এ অনন্য সাংবিধানিক দলিলে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আলোকেই আমরা এই বিষয়গুলো আলোচনা করে দেখতে পারি।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (অনূদিত) স্পষ্টভাবে বলা আছে। “যেহেতু একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ১৯৭০ সনের ৭ ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জনকে নির্বাচিত করেন এবং যেহেতু সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে ১৯৭১ সনের ৩ মার্চ তারিখে মিলিত হওয়ার জন্য আহ্বান করেন। যেহেতু এই আহুত পরিষদ-সভা স্বেচ্ছাচারী ও বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয় এবং যেহেতু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার পরিবর্তে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণের সহিত আলোচনা অব্যাহত থাকা অবস্থায় একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং যেহেতু এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করে এবং বাংলাদেশ মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান এবং যেহেতু একটি বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ, অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের উপর নজীরবিহীন নির্যাতন ও গণহত্যার অসংখ্য অপরাধ সংঘটন করিয়াছে এবং এখনো অনবরত করিয়া চলিতেছে। যেহেতু পাকিস্তান সরকার একটি অন্যায় যুদ্ধ চাপাইয়া দিয়া, গণহত্যা করিয়া এবং অন্যান্য দমনমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণের পক্ষে একত্রিত হইয়া একটি সংবিধান প্রণয়ন এবং নিজেদের মধ্যে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে, যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী উদ্দীপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাহাদের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, সেহেতু আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদ গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতোপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করিলাম।”
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আরও স্পষ্টভাবে বলা আছে, “এতদ্বারা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতা প্রয়োগ করিবেন, একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ এবং তাঁহার বিবেচনায় প্রয়োজনীয় অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ ক্ষমতার অধিকারী হইবেন।”
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, “আমরা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি না থাকা বা রাষ্ট্রপতি তাহার কার্যভার গ্রহণ করিতে অসমর্থ হওয়া বা তাঁহার ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে অসমর্থ হওয়ার ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রপতির উপর এতদ্বারা অর্পিত সমুদয় ক্ষমতা, কর্তব্য ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপতির থাকিবে এবং তিনি উহা প্রয়োগ ও পালন করিবেন।” স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, “আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সনের ২৬ শে মার্চ তারিখে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।”
আমাদের পবিত্র সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য মৌলিক অংশ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাধীনতার ঘোষক এবং প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন করার পরও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমানসহ কিছু জ্ঞানপাপী জিয়াউর রহমানকে কখনো স্বাধীনতার ঘোষক আবার কখনো প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবি করে সংবিধানের প্রতি চরম অবমাননা ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করে আসছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিভ্রান্তির বীজ বপনের গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন।
বিএনপির এ ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিমূলে আঘাত হানতে এবং মুক্তিযুদ্ধের শাশ্বত সত্য ইতিহাসকে বিকৃত করতে ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস: দলিলপত্র গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবর্তে জিয়াউর রহমানের নাম উল্লেখ করেছিল। তখন জোট সরকারের এই ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে জনস্বার্থে মামলা হলে ২১ জুন ‘০৯ তারিখে বিচারপতি এ.বি.এম. খায়রুল হক ও বিচারপতি মমতাজ উদ্দিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক মৌলিকত্ব তুলে ধরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে রায় দিয়ে ইতিহাসের প্রকৃত সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।
এই রায়ের মাধ্যমে ২০০৪ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস: দলিলপত্র গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ড আইন ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করে বাতিল করা হয়। রায়ে স্পষ্টভাবে বলা হয় যে, ২৬ মার্চ প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন যা স্বাধীণতার ঘোষণাপত্রে বলা আছে। সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে এই ঘোষণাকে সাংবিধানিক মৌলিকত্ব দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় কোনো বক্তব্য বা এমনকি কোনো আইন যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
এ লেখার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে অনুরোধ জ্ঞানপাপী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের কথায় কান দেবেন না। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পড়ুন এবং ইতিহাস জানুন, বুঝতে পারবেন কেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির পিতা এবং আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। এ লেখার মাধ্যমে সরকারের কাছে একটি অনুরোধ জানাব তা হলো, নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মতো মুক্তিযুদ্ধের একটি অনন্য সাংবিধানিক দলিলকে আমাদের স্কুল কলেজের পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগটি যেন এ সরকার দ্রুত গ্রহণ করে।
ড. মো. হাসিবুল আলম প্রধান: সভাপতি ও অধ্যাপক, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
এসএন