নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ব্যতীত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মানবাধিকার অবিচ্ছেদ্য বাঁধনে বাঁধা।বাংলাদেশ যখন মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল; গণহত্যায় যখন লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছিল; মুজিবনগর সরকার তখন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করে। এই ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়।
তা ছাড়া এ ঘোষণাপত্রে 'আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার' প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারও করা হয়েছিল। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার মাধ্যমে বাংলাদেশে ‘আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার’ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা দীর্ঘ সময়ের জন্য রুদ্ধ রাখা হয়। সাম্যের বদলে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। মানবিক মর্যাদা হয় ভূলুণ্ঠিত। সামাজিক ন্যায়বিচারের জায়গা হয় ভাগাড়ে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশে নেমে আসে মানবাধিকারবিরোধী দীর্ঘ তমসা। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার অবিভাজ্যরূপে ছিল। পরে ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক রাজনীতির চাপে ইউডিএইচআরের অধিকারগুলোকে আইসিসিপিআর ও আইসিইএসপিআর নামে দুটি আলাদা দলিলে ভাগ করা হয়। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এই বিভাজনকে স্বীকার করেনি। আদি ইউডিএইচআরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা ঘোষণা করেছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অমোঘ বাণী।
গণতন্ত্রের জন্য মানবাধিকার দরকার। মানবাধিকারের জন্য গণতন্ত্র দরকার। বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লুণ্ঠিত হচ্ছে। পুলিশ হেফাজতে মানুষ মারা যাচ্ছে যা সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন।পুলিশ কাস্টোডিতে আসামী মৃত্যুর ঘটনাগুলি খুবই স্পর্শকাতর ও নৈতিকতা বিরোধী যা আজকাল নিয়মিত ঘটছে দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে অর্থাৎমানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ করা বার্ষিক প্রতিবেদনটি ২০২২ সালের পরিস্থিতির উপর হলেও বিস্ময়করভাবে তাতে বাংলাদেশের ২০১৮ সালের নির্বাচনের বিষয়টি টেনে আনা হয়েছে। বিষয়টি ২০১৮ বা ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে প্রাসঙ্গিক হতে পারত। সে সময়ে বিষয়গুলো প্রকাশ না করে, প্রায় চার বছর পর আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে প্রকাশ করার বিষয়টি স্বভাবতই প্রশ্নের সৃষ্টি করে। হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিয়ে প্রতিবেদনটিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২২ সালে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ নিয়ে এই প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সরকারের পক্ষ থেকে এই আইনটির আপত্তিকর ধারা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মার্কিন এই প্রতিবেদনে গুম বিষয়ে বাংলাদেশের দুটি মানবাধিকার সংগঠনের বরাত দেওয়া হয়েছে, যাদের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।অন্যদিকে আমরা আরও দেখেছি, সম্প্রতি র্যাব হেফাজতে এক নারীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনার দ্রুত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির দাবি করছি। আমাদের মনে রাখা উচিত হবে যে, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ব্যতীত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়- এটি চিরন্তন সত্য।পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের নাগরিকরা সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে থাকায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল থেকে গেছে । অন্যদিকে শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিক সমাজ না থাকলেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। অর্থাৎ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষা ও অন্যান্য আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারও সমভাবে বাস্তবায়ন করতে হয়। আদিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই ছিল এই অবিভাজ্য ও অবিচ্ছেদ্য মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে তার সংহতির স্বার্থে প্রতিষ্ঠাকালীন আদর্শধারণ, লালন, প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মানবাধিকার অচ্ছেদ্য বাঁধনে বাঁধা উল্লিখিত কারণে বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হবে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যতিরেকে আমরা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারব না। সে জন্য বাংলাদেশকে তার সব উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। তা ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সবাইকে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নীতি বিশ্ব নাগরিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। পরিশেষে বলতে হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বিজয় অর্জন করতে হলে সব অংশীজনকে একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করতে হবে। সরকারের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়াটা দরকার, তেমনি সরকারের সাফল্যের স্বীকৃতিও থাকা প্রয়োজন। একইভাবে শুধু নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নয়; আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকারসহ সব ধরনের মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার হতে হবে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। এসব অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিরলস কাজ করতে হবে। পরিবেশগত অধিকারও মানবাধিকার; একেকটি জনগোষ্ঠীর অধিকার। এই অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
ড. মিজানুর রহমান: সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন