বাজারে অস্থিরতা ও সরকারের করণীয়
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যুক্তিসংগত কোনো কারণ নেই বলে আমি মনে করি। আমরা জানি, চাহিদা বেড়ে গেলে সরবরাহ কম হয়। আমাদের চাহিদা বেড়ে গেছে যেকারণে সরবরাহজনিত সমস্যায় বর্তমানে দ্রব্যমূল্য লাগামহীন।
দেখা যাচ্ছে, অনেকে অতি লাভের আশায় খাবার গুদামজাত করে রেখেছেন রমজানে বেশি মুনাফার আশায়। জনগণের চাপে হোক আর স্বেচ্ছায় হোক, সরকার টিসিবির পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি শুরু করেছে। টিসিবির লাইন প্রতিনিয়ত দীর্ঘ হচ্ছে। কেবল নিম্ন বা নিম্নমধ্যবিত্তই নয়, মধ্যবিত্তরাও আজ দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ টিসিবির পণ্য বাজারদামের চেয়ে কিছুটা সহনীয়। গ্যাস, বিদ্যুৎ,পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। যে কারণে সংসার খরচ বেড়ে গেছে। সেই তুলনায় মানুষের আয় বাড়েনি। পরিবহন খরচ বেড়েছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ বেড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে জীবনযাত্রার মান কমে গেছে।
মানুষ আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের তাল মেলাতে পারছে না। দেশের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষরা অনেকদিন ধরেই কষ্ট সহ্য করে আসছে। বিগত দুই বছরে করোনা মহামারির কারণে অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়েছে। যে সকল জিনিসের দাম বেড়ে গেছে সেগুলো কিন্তু বাজারে আছে। সাপ্লাইয়ের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বাজারজাতকরণের ব্যাপারে যথেষ্ট ঝামেলা দেখা যায়। এখন সমস্যা হচ্ছে খাবার দাবারের সঙ্গে ইন এ সাইকেল অন্যসব কিছুর দাম বেড়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গে ইলেক্টট্রিক টুলস এমনকি সেবার মূল্যও বেড়ে যাচ্ছে। একারণগুলোর জন্য যাদের স্বল্প আয় অর্থাৎ মার্জিনাল ইস্যু, প্রান্তিক জনগণ , তাদের যতটুকু সঞ্চয় আছে সেসবও খরচ হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে ডিপোজিটও কমে যাচ্ছে। কারণ লোকজনের যতটুকু সঞ্চয় তা সব নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া অন্যকারণও আছে। সুদের হার কম। লোকজন সঞ্চয় রাখে না। এখন সবচেয়ে বড় দরকার সরকারের একটি কঠোর পদক্ষেপ। আমি মনে করি, কঠোর কয়েকটি পদক্ষেপ নিলে, যদি বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। এখন ধমক দিয়ে দাম কমানো এগুলো কোনো কাজের কথা না। মানুষের মূল্যবোধ জাগ্রত হওয়া জরুরি। আন্তর্জাতিকভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে তাই মূল্যস্ফীতি বাড়বে এটি ঠিক নয়। মূল্যবৃদ্ধি পাওয়া জিনিসগুলো হয়ত আমদানি হয়েই আসেনি অথচ দাম বেড়ে গেছে। এ সব কাজগুলো হচ্ছে। এজন্যই আসল কথা হল, আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ম্যানুপুলেশনের কোনো শাস্তি নেই। কোনো এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে না এলে আমরা উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছে যাবো, এগুলো আমার কাছে মনে হয় অনেকটা ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছু নয়। জনগণের জীবন যাত্রার মান যদি উন্নত না হয়, তাহলে এ সব কথা অর্থহীন। আমাদের জীবনে নৈতিকতার বড় অভাব।
আমাদের এই বলয় থেকে বেড়িয়ে আসা উচিত। উপায় হচ্ছে, বাজারের উপর সচেতনভাবে নজরদারি বাড়াতে হবে। পর্যাপ্ত মজুদ থাকতে হবে। এখন সরবরাহ কিন্তু কম না, কিন্তু দাম বেড়ে যাচ্ছে। সরকার অনেক করবে, এই করবে, সেই করবে কথাগুলো অর্থহীন। ম্যানুপুলেশন দূর করতে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ইম্পোরটেড প্রডাক্টের দাম কতটুকু বেড়েছে সেই অনুপাতে বাজারে দাম বেড়েছে কি না সেগুলো কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে যদি ৫ ডলার বাড়ে, বাংলাদেশের বাজারে বাড়বে ২০ ডলারের মতো। শুধু বাজার নিয়ন্ত্রণ করেও এর সমাধান সম্ভব নয়। প্রশাসনিকভাবে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া মূল্যস্ফীতি কমানোর কোনো বিকল্প নেই বলে আমি মনে করি ।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: সাবেক গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক
আরএ/