মাতৃমৃত্যু রোধে অগ্রগতি যেখানে থমকে গেছে
মাতৃমৃত্যু রোধে বাংলাদেশ বেশ এগিয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। কিন্তু প্রত্যাশার জায়গা থেকে আমরা অনেক দূরে অবস্থান করছি। বর্তমানে মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস পেয়ে লাখে ৫০০ থেকে ১৬৩ জনে নেমে এলেও এটি শূন্যতে নেমে আসাই প্রত্যাশিত। যদিও এসডিজিতে ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ৭০-এর নিচে মাতৃমৃত্যু হার নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
মাতৃমৃত্যু হার কমানো আমাদের 'থ্রি জিরো এজেন্ডা'র অন্যতম। যেখানে আমরা একই সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অপূর্ণ চাহিদা শূন্যতে আনা, শূন্য মাতৃমৃত্যু হার, যৌন ও জেন্ডারভিত্তিক নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করছি। সম্প্রতি জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল-ইউএনএফপির সঙ্গে যৌথভাবে পিপিআরসি 'থ্রি জিরো অ্যাকশন নেটওয়ার্ক' উদ্বোধন করে। আমরা তিনটি বিষয়ে একত্রে যেমন কাজ করছি, তেমনি প্রতিটি বিষয় নিয়েও আলাদা ফোকাস করে ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরেও আমরা কর্মসূচি পালন করছি। তারই আলোকে গত ১৩ ডিসেম্বর সিলেটে আমরা মাতৃমৃত্যু হার নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করি।
মাতৃমৃত্যু রোধে আমরা সমন্বিত পদক্ষেপের কথা বারবার বলেছি। স্বাভাবিকভাবেই এখনো গ্রামে মাতৃমৃত্যু হার বেশি। বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপের তথ্য অনুযায়ী রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল ও সিলেট বিভাগে এ হার তুলনামূলক বেশি। বিষয়টি নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের তথ্য অনুসারে— দেশে রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনির কারণেই অধিকাংশ প্রসূতি মারা যান। অথচ এটি প্রতিরোধযোগ্য। বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে প্রসব অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্তঃসত্ত্বার কয়েকটি বিপদ চিহ্ন রয়েছে। হঠাৎ রক্তপাত, খিঁচুনি, চোখে ঝাপসা দেখা, ভীষণ জ্বর ও বিলম্বিত প্রসবের ক্ষেত্রে নাজুক মাকে যে হাসপাতাল বা নিকটস্থ স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে নিতে হ— সে বিষয়ে সচেতনতার কাজটি গুরুত্ব দিয়ে করা দরকার। তাদের দ্রুত হাসপাতালে আনতে পারলে মাতৃমৃত্যু সমস্যার বহুলাংশে সমাধান হতে পারে।
তবে এটাও বলা প্রয়োজন, স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আমাদের যথেষ্ট উদ্বেগ রয়ে গেছে। এমনও আছে, হাসপাতালে নিলেও অন্তঃসত্ত্বার জটিল চিকিৎসায় অগ্রগতি যথেষ্ট হয়নি। মাতৃস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা না গেলে অবস্থার কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নতি ঘটবে না। আমরা যদি মাতৃমৃত্যু কমাতে চাই, তবে সেবা প্রদানের নিশ্চয়তা ও ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। যে পরিবেশ আছে তাতে আরও যত্নবান হতে হবে। কোনো প্রসূতি যদি হাসপাতালে আসার পরও মারা যান, সেটি নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক। তাদের চিকিৎসা সরকারি হাসপাতাল কিংবা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যে চিকিৎসালয় রয়েছে, উভয় ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত সেবাদানকারী সেবা নিশ্চিত করা চাই।
অন্তঃসত্ত্বাদের সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে কোথায় ফাঁকফোকর আছে, তা খুঁজে বের করতে হবে। নিরাপদ ডেলিভারি নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য খাতে নানা অসংগতি দূর করতে হবে। চিকিৎসক, সমাজকর্মী, এনজিও, রাজনীতিকসহ সবার অংশগ্রহণ মাতৃমৃত্যু হার হ্রাসে সহায়তা করে। সে জন্য সবার মধ্যেই সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মহামারি করোনা বিশ্বকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে চরম বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এর প্রভাবে সমাজে বাল্যবিয়ে বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বেড়েছে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা। কোভিড স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আমাদের যে নাজুক পরিস্থিতি দেখা গেছে, অন্তঃসত্ত্বার সুরক্ষায় তার প্রভাবও পড়েছে।
থ্রি জিরো এজেন্ডায় মাতৃমৃত্যুহার কমানো নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বলাবাহুল্য, থ্রি জিরো এজেন্ডার উৎস হলো, ১৯৯৪ সালে মিসরের কায়রোয় জনসংখ্যা ও উন্নয়নবিষয়ক ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন (আইসিপিডি)। ওই সম্মেলনে প্রথমবারের মতো জনসংখ্যার অধিকারের বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়। সেই সম্মেলনের ২৫ বছরপূর্তিতে ২০১৯ সালে কেনিয়ার নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত হয় আইসিপিডি সম্মেলন। নাইরোবি সম্মেলনেই মূলত 'তিন শূন্য লক্ষ্যমাত্রা'কে ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনে এজেন্ডাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়। কায়রো সম্মেলনের ২৫ বছরপূর্তিতে ওই সম্মেলনে নারী ও মেয়েদের সমধিকার, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার, ব্যক্তির মানবাধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিতকরণ যে টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত, সেটি পুনর্ব্যক্ত করা হয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, উন্নয়নের লক্ষ্য হলো সব মানুষের জীবনের গুণগত মানের উন্নয়ন। জনসংখ্যার পরিমাণগত আকারের পাশাপাশি গুণগত উন্নয়নও অত্যাবশ্যক। এ লক্ষ্যে আইসিপিডি এক মাইলফলক। সেখানে তিন শূন্য লক্ষ্যমাত্রাকে গুরুত্ব দিয়ে এজেন্ডাভিত্তিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি প্রয়োজন। অথচ অন্যান্য বিষয়ের মতোই মাতৃমৃত্যুর ক্ষেত্রে অগ্রগতি
সন্তোষজনক নয়।
এ ক্ষেত্রে কতটা কাজ হলো, তা নিরূপণ এবং এ কাজের ক্ষেত্রে সমন্বিত প্রচেষ্টার জন্যই আমরা থ্রি জিরো অ্যাকশন নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। শুরুতেই বলেছি, মাতৃমৃত্যুহার রোধে আমরা বেশ এগিয়েছি। আরও দুটি ক্ষেত্রেও উন্নয়ন দৃশ্যমান। কিন্তু উন্নয়ন এক জায়গায় এসে আবার যেন থমকে গেছে। যেমন ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা মাতৃমৃত্যু ৭০-এ নামাতে চাই। অথচ আমরা আছি এখন ১৬৩তে। কিন্তু আমাদের হাতে সময় বেশি নেই; মাত্র ৮ বছর। আমাদের অগ্রগতি ধীরগতিতে হচ্ছে। এ পর্যায়ে এসে আমরা যদি লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই, তবে আমাদের দ্বিগুণ প্রচেষ্টা লাগবে। তবে ধীরগতির ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ বড় কারণ নিঃসন্দেহে। মহামারি অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতি ধীর করেছে, কোথাও আরও পেছনে ঠেলেছে। সে জন্যই মাতৃমৃত্যুহার রোধসহ অন্য ক্ষেত্রে আমাদের একটা ধাক্কা লাগবে। থ্রি জিরো অ্যাকশন নেটওয়ার্ক সেই ধাক্কার কাজটি করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
আমাদের সার্বিক উন্নয়নেই মাতৃমৃত্যু রোধ করা জরুরি। আবার আমরা সত্যিকার অর্থেই কতটা এগোলাম, তার অন্যতম নিরূপক মাতৃমৃত্যু হার। মাতৃমৃত্যু হার রোধসহ তিনটি ক্ষেত্রের কোনোটিতেই সরকার কিংবা নাগরিক সমাজের সদিচ্ছার অভাব নেই। তবে অনেক কিছু আছে কাগজ-কলমে। এ ক্ষেত্রে সফল হতে গেলে আমাদের 'কমিউনিটি'কে কাজে লাগাতে হবে। যেমন বাল্যবিয়ে রোধে আমাদের উপজেলা কমিটি আছে। কিন্তু কমিটি আদৌ কাজ করছে কি না; তাদের তহবিল আছে কি না, তা দেখতে হবে। মাতৃমৃত্যু হার রোধেও সমাজের দায়িত্ব রয়েছে। সামাজিক সচেতনতা ও জাগরণ তৈরি হলে সামাজিক নর্মস কিংবা দায়িত্ববোধ থেকেই নাজুক মায়েদের চিকিৎসায় মানুষ এগিয়ে আসবে। তাকে হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে। আমরা এই সামষ্টিক প্রচেষ্টার কথাই বলছি এবং লক্ষ্যে পৌঁছাতে সেটা এখনই জরুরি।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: অর্থনীতিবিদ ও এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান, পিপিআরসি
আরএ/