নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন ও বিশ্বভারতীর কাণ্ড
অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অমর্ত্য সেন কি জমি চুরি করেছেন? জমির পরিমাণ কত? ১৩ ডেসিমেল। এই অভিযোগ করেছেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। কে এই বিদ্যুৎ চক্রবর্তী?
ছাত্রাবস্থা থেকে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী আরএসএস এর সদস্য। তার উপদেষ্টা হলেন আরএসএস নেতা স্বপন দাশগুপ্ত। স্বপনের আরও একটা পরিচয় আছে। পূর্ব পাকিস্তান আমলে তার শ্বশুর অশোক রায় ভারতের বিদেশ মন্ত্রকে কাজ করার সময় যেখানে যেতেন সেখানে আরএসএস এর প্রচার করতেন। চাকরি জীবন তার শেষ হয় পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায়। স্বপন একসময় আমাদের সঙ্গে টেলিগ্রাম কাগজে কাজ করতেন। আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করতেন আরএসএস কত ভালো।
এখনো বিশ্বভারতীর ব্যাপারে স্বপন প্রতিটি ক্ষেত্রে নাক গলায়। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ থেকে আসা এক ছাত্রীকে বিনা কারণে নানা কটূক্তি করেছিলেন এই দুজন। তারপরই তাকে বরখাস্ত করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ বা স্বপন কেউই বাংলাদেশের এই জেদি ছাত্রীকে আটকাতে পারেননি। তিনি কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করে বিশ্বভারতীতে লেখাপড়া শেষ করেছেন। গেরুয়া বাহিনীর এই সম্পর্কে গোটা পশ্চিমবঙ্গ থেকে ধিক্কার উঠেছে। সবাই ছি ছি করছেন। শেষ পর্যন্ত অমর্ত্য সেনের নামেও চুরির অপবাদ? এ কি বিশ্বাসযোগ্য? ঢাকার বিক্রমপুরের এই অর্থনীতিবিদের জন্মও শান্তিনিকেতনে। তার মা অমিতা সেনগুপ্ত শিশুটিকে কোলে নিয়ে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের কাছে নামকরণ করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তার নাম দিয়েছিলেন অমর্ত্য। এখনো ৯০ বছর বয়সে তিনি অক্সফোর্ড হার্ভার্ডে ক্লাস নেন।
এ ব্যাপারে অমর্ত্য সেন নিজেই কী বলেছেন তা দেখা যাক। তিনি বলেছেন, তাকে দু চার ঘা দিলে দিল্লীর কিছু উপকার হতে পারে। সম্প্রতি অমর্ত্যের তরফে বিশ্বভারতীকে চিঠি দিয়ে আইনি হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
বিশ্বভারতী যে বারে বারে অমর্ত্যকে চিঠি দিয়েছে শেষ চিঠিতে অমর্ত্যের পৈত্রিক জমি মাপজোকের প্রস্তাব দিয়েছে। সেজন্য তাদের ক্ষমা চাইতেও বলা হয়েছে। অমর্ত্যকে জবাব দিতে সংবাদমাধ্যমকে উপাচার্য জানান, তিনি যে অবস্থান নিয়েছেন, সে ব্যাপারে দিল্লী হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। উপাচার্য হিসেবে আমাকে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তার সঙ্গে বাইরের শক্তির কোনো যোগাযোগ নেই।
অমর্ত্য এক বিবৃতিতে বলেছেন ১৩ ডেসিমেল জমি আমি বাল্যকাল থেকে ব্যবহার করছি। সেই জমির উপর আমার কোনো অধিকার নেই। সেটি নাকি বিশ্বভারতীদের জন্য নিজস্ব। প্রশ্নটি তাই এই নয় যে, ১৩ ডেসিমেল জমি মাপজোক করা হলে কি পাওয়া যাবে। ভালো করে মাপলে ১৩ ডেসিমেল জমি ১৩ ডেসিমেলই থাকবে। এরপরেই তিনি বলেন, কি কারণে তিনি অংক কষেন— বিশ্বভারতীর কর্মকর্তাদের তা জানার প্রয়োজন হয়ত একটু হ্রাস পেত। বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীদের অকারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্বাসিত হওয়ার ভয়ও একটু কমতো।
বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আদালতে উঠেছে। তার পক্ষ থেকে ছাত্রছাত্রীরা মোদী সরকারকে ধিক্কার জানিয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন। সংবাদপত্রে সেগুলো প্রকাশিত হচ্ছে। অমর্ত্যর জমি নিয়ে শান্তি নিকেতনে যা ঘটছে তা অভাবনীয়। বিশ্ববরেণ্য পন্ডিত সুরে সুর মেলাচ্ছেন না বলে তাকে কর্দমাক্ত করার জন্য প্রতিষ্ঠান যদি উঠেপড়ে লাগে, চিন্তার মূল অর্থই অবরুদ্ধ হয়। লড়াই সংঘর্ষ যদি হয়, তা বিপরীত চিন্তার বা যুক্তির প্রসারের মধ্য দিয়েই হওয়া বাঞ্ছনীয়। যে মানুষটিকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা তাকে দেখে প্রতিষ্ঠান ভয় পাচ্ছে চলমান অগ্নিবলয়ের মতো। যেকোনো সমাজের অগ্রসরমান হওয়ার একমাত্র ভাষা সহিষ্ণুতা। লড়াই হোক সেই চিন্তার মাঠেই, এমনটিই ভাবছেন এই বাংলার চিন্তার বিশিষ্টজনরাও।
অমর্ত্য সেনের দাদামশাই ক্ষিতিমোহন সেন, মা অমিতা সেন, বাবা আশুতোষ সেন বিভিন্নভাবে বিশ্বভারতীকে সমৃদ্ধ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সময় থেকেই অশ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন প্লটে জমি নির্দিষ্ট করে অথবা লিজ হিসেবে দেওয়া ছিল। উপাচার্য নিকৃষ্ট বাক্য প্রয়োগে সেখান থেকে তাদের উৎখাত করার চেষ্টা করছেন। বিষয়টি নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি করে চলেছেন। এমনকি হাস্যকরভাবে অধ্যাপকের নোবেল প্রাপ্তি নিয়েও সংশয় প্রকাশ করছেন। এতেই তার স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে। উপাচার্য নিজেই নিজেকে অসম্মানিত করছেন।
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক
আরএ/