মূল্যস্ফীতি সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনের উপর নির্ভরশীল
আমাদের অর্থনীতি এখন বিশ্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সারাবিশ্বে যাই হোক না কেন আমরা প্রবৃদ্ধি চালিয়ে যাব, এটা একেবারেই অমূলক। বিশ্বের সঙ্গিন অবস্থার কারণে আমাদের এখানেও তার প্রভাব পড়বে এবং সেটিই হয়েছে।
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমরা যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাই তাহলে প্রথম কাজ হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো। এক্ষেত্রে কিছুটা করছাড় দেওয়া গেলে মূল্যস্ফীতি একটু নিয়ন্ত্রণ করা যেত। সেখানে সম্পূর্ণ করছাড় দিচ্ছি না আমরা। মাত্র দু-একটা পণ্যের ওপর করছাড় দেওয়া হচ্ছে। ভোজ্যতেলের ওপর আগে কিছুটা কর কমানো হয়েছিল। কিন্তু খুব একটা সুবিধা হয়নি। আরেকটা বিষয় হলো, ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিনের দাম বাড়ার ফলে অনেকে কিন্তু পাম তেল ব্যবহার করছেন। এর ওপর করছাড় হয়নি। তাই বাজেটের মধ্যে মোকাবিলার যে আর্থিক পদক্ষেপ তা দেখা যাচ্ছে না। ফলে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির চাপটা থাকবে।
দ্বিতীয়ত, সরাসরি কিছু সহায়তার জন্য আর্থিক বরাদ্দ দেওয়া যেত। শুধু দরিদ্র নয়, মধ্যবিত্তের জন্যও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি অসহনীয় হয়ে উঠছে। তাদের জন্য স্বল্পমূল্যে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা, খোলাবাজারে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা বাড়ানো দরকার। খোলাবাজারের আওতা বাড়াতে হবে, যাতে অনেক মানুষ এর সুফল পায় এবং এতে আরও অধিক পণ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
একই সঙ্গে নিরাপত্তাবেষ্টনীর সুফলভোগীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাদের ভাতা বাড়াতে হবে। দুঃখজনকভাবে সামাজিক নিরাপত্তার বাজেট জিডিপির তুলনায় এখনো অনেক কম। এ বছরে এ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। কিন্তু এর মধ্যে আবার সরকারি কর্মচারীদের পেনশন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পুরো সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ এত কম বাড়লেও পেনশনের অংশটা বেড়েছে ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। আবার যদি ভাগ করে দেখি, অনেক কর্মসূচির বরাদ্দ কমে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, খোলাবাজারে পণ্য বিক্রির জন্য বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫ শতাংশ কমে গেছে।
এদিকে তিন বছর ধরে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকা রাখা হয়েছে। এটা চাইলেই সাড়ে ৩ লাখ করা যেত, এমনকি ৪ লাখও করা যেত। তাতে এমন কিছু হতো না। বরং মানুষের উপকার হতো। সত্য যে রাজস্ব কিছুটা কমত। কিন্তু সরকার তো অনেককে নানাভাবে রাজস্ব সহায়তা দিচ্ছে। সেখান থেকেও তো কর আদায় কমে যাবে। মূল বেতনের বাইরে যে ভাতা থাকে, যেমন বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ভাতার করমুক্ত সীমাটা সাড়ে ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা করা হয়েছে। সেখান থেকেও সরকার কিছুটা করবঞ্চিত হবে। আবার বিভিন্ন বিনিয়োগে মানুষ যে কর রেয়াত পায়, সেটাও ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। সেখানে তো একটা স্বস্তি দেওয়া হলো। সব মিলিয়ে স্বস্তির জায়গাটা হলো যারা ভালো অবস্থায় আছে তাদের জন্য। কিন্তু এটা তো দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য কোনো কাজে আসছে না। যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তারা তো পাচ্ছে না।
আমাদের দেশে কর্পোরেট কর বেশি। এ কারণে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না, বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। কাজেই কর্পোরেট কর কমানোর জন্য দাবি রয়েছে। কিন্তু এতে দরিদ্র জনগণ সরাসরি উপকৃত হবে না। একটা প্রবৃদ্ধিমুখী পদক্ষেপ এবং এর ফল পেতে কিছুটা সময় লাগবে। তা ছাড়া এ মুহূর্তে কে বিনিয়োগ করবে এবং ফলাফল কতদিনে দেখব। তার চেয়ে বরং আগামী এক বছরের জন্য জরুরি ব্যবস্থাপনা দরকার।
তাই আমি মনে করছি না মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য আসলে যথেষ্ট আর্থিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে মনিটরিং ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে। মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা হবে। আমাদের দেশে তো মুদ্রানীতি খুব একটা কাজ করে না। বর্তমানে শুধু আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণের জন্য যদি মুদ্রানীতি ঠিক করি তাহলে সেটি একপক্ষীয় হয়ে যাচ্ছে। বরং কোন পণ্য আমদানি করা এখন দরকার এবং কোনগুলো এখন দরকার নেই, সেগুলো চিহ্নিত করে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারি। চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির হার ১৬ শতাংশ কমে গেছে। তাহলে কীভাবে আমরা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্থিতিশীলতা বজায় রাখব। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে অনেক, বেড়েছে চলতি হিসাবের ঘাটতি। এ সব ঘাটতি মিলে বহিঃখাতের ওপর প্রচণ্ড চাপ দেখা যাচ্ছে।
আমরা শুধু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে চিন্তা করছি। সরকারিভাবে খাদ্যের মজুদ বা ভোজ্যতেলের মজুদ নিয়ে চিন্তা করছি না। এ সব মজুদ বাড়াতে অন্য সরকারগুলো কী করছে, সেটা দেখছি না। কেবল বলছি, আমাদের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কমবে, বিনিয়োগ বাড়বে ইত্যাদি। সেগুলো নিয়ে মোহগ্রস্ত হয়ে আছি। কিন্তু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি পর্যাপ্ত নয়। এখানে সংবেদনশীল চিন্তাভাবনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ কিছুটা কমেছে। কিন্তু তারপরও এখনো ভালো অবস্থায় আছে। সেটা দিয়েই আমাদের খাদ্যদ্রব্য ও জ্বালানিপণ্য আনার প্রস্তুতি নিতে হবে। দ্বিতীয় বিষয় হলো ব্যবস্থাপনা। এটা সামগ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা, ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনের ওপর নির্ভরশীল। যাতে আমরা দুর্নীতিমুক্তভাবে খাদ্য ও পণ্যের মজুদ ব্যবস্থাপনা করতে পারি। তার জন্য যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের আরও সক্রিয় হতে হবে।
ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি
আরএ/