অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি গ্রামীণ রূপান্তরে মনোযোগ দিতে হবে
গ্রামীণ রূপান্তর নিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন সামনে আসছে। এগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি। স্বীকার করতেই হবে, গ্রাম নিয়ে সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার ঘাটতি রয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে বটে, কিন্তু তার বিস্তৃতি বাড়েনি। সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন গ্রামীণ বাস্তবতায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য দেখার আছে- নতুন গ্রামীণ বাস্তবতায় ক্ষমতা বলতে কী বোঝায় এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুগুলো কী? আগে গ্রামের ক্ষমতাকাঠামোয় জোতদার, মাতব্বর প্রভৃতি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী ছিল। এখন সেখানে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। গ্রামীণ ক্ষমতার কেন্দ্রের মধ্যে পুলিশের উপস্থিতি এখন দৃশ্যমান। গবেষণার একটা বিষয় হতে পারে, গ্রামে আজকাল কী নিয়ে ঝগড়া হয়? গ্রামীণ বিবাদের মূল বিষয়গুলো কী? বিবাদের ধরনগুলো বুঝলে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রগুলো সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। নারীর আবির্ভাবও গ্রামীণ বিবর্তনের একটি নিয়ামক শক্তি। আরেকটা বড় ইস্যু চলে আসছে পরিবেশ। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ঢাকায় যত সেমিনার হয়, তার তথ্যউপাত্ত আসে গ্রাম থেকেই। উপকূলীয় অঞ্চলে কয়েকটা ঘূর্ণিঝড় হলো, সেটার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন কতটা দায়ী ইত্যাদি বিষয় রয়েছে।
আরেকটা বড় বিষয় হচ্ছে গ্রামীণ সংস্কৃতির পরিবর্তন। সংস্কৃতির বিবর্তনটা গ্রামে কেমন হয়েছে? একটা বিষয় আমরা বুঝতে পারছি গ্রামে নগরের সংস্কৃতি, এমনকি বিশ্ব সংস্কৃতি প্রবেশ করছে। বাউল গান, যাত্রাপালা, পটগান ইত্যাদি একসময় গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ ছিল। এখন সেখানেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। ক্যাবল টিভি এখনো গ্রামেও বিস্তৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে গ্রামীণ সংস্কৃতির বিবর্তনটা কেমন হচ্ছে, সেটাও খুব স্পষ্ট নয়। এর ফলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিভেদ তৈরি হচ্ছে, যা অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য সুখকর নয়।
গ্রাম হচ্ছে পুনর্জন্মের আধার। গ্রাম হচ্ছে বাড়ি। বাড়ি শব্দটা এখনো ব্যবহার হয়। মানুষকে তার বাড়ি জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি ওমুক গ্রামে। পৃথিবী যদি বিলীন হয়ে যায়, তাহলে আমি কোথায় গিয়ে থাকব? আমি গ্রামের বাড়িতে থাকব, এ ধারণাটি এখনো বিদ্যমান। কভিডের সময়ে কর্মসংস্থান হারিয়ে মানুষ গ্রামে ফিরেছে। সুতরাং গ্রামের মনস্তাত্ত্বিক আকর্ষণ এখনো রয়েছে। এক্ষেত্রে গ্রাম হচ্ছে আশ্রয়স্থল, সেখানে এত নিয়ম-কানুন নেই। যে নিয়ম-কানুনগুলো আছে, সেগুলো সামাজিক নিয়ম-কানুন। যেটা সবাই আত্মস্থ করে রেখেছে।’
এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন রেখে গ্রামীণ রূপান্তরের এবারের পর্ব শেষ করতে চাই। পারিবারিক ব্যবস্থা কি গ্রামেও ভেঙে গেছে? আমরা জানি শহরে মানুষ আসে, হঠাৎ করে চলেও যায়। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন শহরের অভিবাসনকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তার পরও মনস্তাত্ত্বিক আশ্রয়স্থল হিসেবে শহর এখনো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। ব্যতিক্রম হিসেবে বিশেষ একটা গোষ্ঠী হয়তো করতে পেরেছে। এমনকি শহরের মধ্যে পাড়াভিত্তিক যে কমিউনিটি লাইফ ছিল, সেটাও ছিল গ্রামীণ সমাজের একটা রূপান্তর। গ্রামের পাড়াকে কেন্দ্র করে শহরের পাড়া গড়ে উঠেছিল। গ্রামের মনস্তাত্ত্বিক আশ্রয়স্থলকে মানুষ নগরে নিয়ে এসেছিল। গ্রামে পাড়ার কী অবস্থা? সেটি ভেঙে গেছে, নাকি চিন্তার মধ্যে একটা অবস্থান এখনো রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের পাঠ ও পরের স্তরকে বুঝতে হলে গ্রামের রূপান্তর সম্পর্কে সম্মুখ ধারণা লাভ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণা প্রয়োজন। কারণ ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় অংশের জোগান আসবে গ্রাম থেকে। ফলে গ্রামের কাঠামোগত বিবর্তন, বিন্যাস সম্পর্কে ধারণা লাভ না করে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন কঠিন হয়ে পড়বে। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নীতি গ্রামীণ রূপান্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বাস্তবতা উপলব্ধি করে গ্রামীণ রূপান্তরকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার, ব্যক্তি খাত ও এনজিওকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: নির্বাহী চেয়ারম্যান, পিপিআরসি ও চেয়ারম্যান, ব্র্যাক।
এসএন