বেগম রোকেয়া ও নারীর অধিকার
বাঙালি মুসলিম নারী সমাজের শিক্ষার কথা বলতে গেলে প্রথমেই যার নাম আসে তিনি হলেন বেগম রোকেয়া। আমাদের সমাজ ও সাহিত্যের ইতিহাসে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন একটি বিশিষ্ট আসন অধিকার করে আছেন। স্ত্রীশিক্ষার বিস্তারে, বিশেষ করে, মুসলিম বালিকাদের শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে, তার সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা চিরস্মরণীয়। নারীর অধিকার রক্ষার আন্দোলনেও তিনি অগ্রবর্তী।
বেগম রোকেয়ার হাতেই গড়া তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছাত্রী শামসুননাহার মাহমুদ তার রোকেয়া জীবনী গ্রন্থে উল্লেখ করেন ‘বোন, এই ইংরাজী ভাষাটা যদি শিখে নিতে পারিস, তবে পৃথিবীর এক রত্নভান্ডারের দ্বার তোর কাছে খুলে যাবে।’- পরম আদরের বালিকা ভগ্নির সম্মুখে একখানা বড় ছবিওয়ালা ইংরাজী বই খুলিয়া ধরিয়া এই কথা কয়টি উচ্চারণ করিয়াছিলেন, আজি হইতে প্রায় পঞ্চাশ বৎসর আগে এক কিশোর যুবক। কি ছিল কথাগুলির মধ্যে জানি না, কিন্তু কি এক যাদুমন্ত্রের প্রভাবে বালিকার হৃদয় মুগ্ধ হইল। সেদিন সেই মুহূর্তে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কাছে জ্ঞানসাধনার যে মহামন্ত্রে তিনি দীক্ষিত হইলেন, তাহাই হইয়াছিল তাঁহার জীবনের মূলমন্ত্র। বালিকার নাম রোকেয়া। উত্তরকালে ইনিই মিসেস আর.এস. হোসাইন নামে বাংলা দেশে পরিচিত হন। বাংলার মুসলমান নারীপ্রগতির ইতিহাস-লেখক এই নামটিকে কখনো ভুলিতে পারিবেন না।’
বেগম রোকেয়া যে যুগে জন্মিয়াছিলেন এই বাংলার মাটিতে, সে ছিল মুসলিম ভারতের ইতিহাসে এক আঁধার যুগ। রাজ্য গিয়াছিল, সিংহাসন গিয়াছিল-সেটা তত বড় কথা নয়। ঊনবিংশ শতাদ্বীর শেষভাগে অশিক্ষা ও কুসংস্কারের ভেতর দিয়া আসিয়াছিল জাতির সবচেয়ে বড় অকল্যাণ। ইসলামের সত্যিকারের শিক্ষা ভুলিয়া হৃতসর্বস্ব মুসলমান সেদিন হাবুডুবু খাইতেছিল কুসংস্কার আর গোঁড়ামির পাঁকে।
যে সময় গোটা সমাজের ছিল এমন শোচনিয় অবস্থা, তখন কুলবালাদের দশা ছিল কি-আজ পঞ্চাশ বৎসর পরে তাহা কল্পনা করিতেও আমাদের দেহ কন্টকিত হয়। জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত অন্ধকার পুরীর বিষাক্ত আবহাওয়ার মধ্যে বন্দিনী মুসলিম নারী। শিক্ষার আলোক তাহাদের জন্য হইয়াছিল হারাম; সত্য ও সুন্দর তাহাদের জীবন হইতে হইয়াছিল একেবারে নির্বাসিত।
সেই বীভৎস আঁধারে বেগম রোকেয়ার মনে কেমন করিয়া জ¦লিয়াছিল জ্ঞানের আলো, কেমন করিয়া জাগিয়াছিল মুক্তির পিপাসা-তাহা বাস্তবিকই ভাবিবার বিষয়। ভ্রান্ত মোল্লাদের প্রতিবাদ তুচ্ছ করিয়া, সমাজের তীব্র কটূক্তি অগ্রাহ্য করিয়া আপন হৃদয়মন তিনি আলোকিত করিয়াছিলেন শিক্ষার আলোকে, স্বাধীনচিন্তার আলোকে। শুধু তাহাই নয়। সেই আলোকের ক্ষীণ শিখায় ব্যথিত দৃষ্টি মেলিয়া তিনি দেখিয়াছিলেন তাঁর চারপাশের সমাজ,--অবরোধ-বন্দিনী নিগৃহীতা নারীসমাজ। শুধু দেখিয়া তিনি চুপ করিয়া থাকেন নাই। তাহার অজ্ঞানতা ও নির্জীবতার বেদনা তাঁহাকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছিল। শত শত বন্দিনী নারীর মর্মের কথা অসহ্য বেদনায় রূপলাভ করিয়াছিল তাঁহার লেখায়, তাঁহার সাহিত্যে, তাঁহার জীবনের প্রত্যেকটি কাজে। কেমন করিয়া শত বাধা-নিষেধের নাগ পাশ হইতে তাহাদের মুক্তি দেওয়া যায়, কেমন করিয়া আলোকের পথে, কল্যাণের পথে, ধ্রুব ও সত্যের পথে তাহাদের তুলিয় দেওয়া যায়--এই-ই হইয়াছিল তাঁহার দিনের চিন্তা আর রাত্রির স্বপ্ন। সেই কাল রাত্রির অন্ধকারে জ্ঞানের দীপ না জ¦লিলে হতভাগিনী বন্দিনীদের মুক্তি নাই, তিনি বুঝিয়াছিলেন এই কথা। ভিতর হইতে সাড়া না আসিলে কারাগৃহের দ্বারের অর্গল খুলিবে না, তিনি উপলব্ধি করিয়াছিলেন এই সত্য। তাই ঘুমন্ত নারী-শক্তিকে নব জীবনের বোধন-মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করিয়া তুলিবার ভার লইয়াছিলেন তিনি আপন হাতে। তাদের প্রত্যেকটি জীবনকে উন্নত, আলোকিত ও সুন্দর করিয়া তুলিবার সাধনাই হইয়াছিল তাঁহার জীবন।
পঞ্চাশ বৎসর আগেকার মুসলমান নারীসমাজ আর আজিকার সমাজের অবস্থা তুলনা করিতে গেলেই চোখে পড়ে একটা বিরাট পরিবর্তন। যুগযুগান্তের স্বপ্নের কুহক ভাঙ্গিয়া আজ তাঁহারা জাগিয়াছেন। বন্ধন কাটিয়া একে একে দু’য়ে দু’য়ে তাঁহারা আজ সমবেত হইতেছেন মুক্ত বিশ্বের মুক্ত আকাশতলে। জগতের জাগর লোকে তাঁহাদের শূন্য আসন আজ সত্য সত্যই পূর্ণ হইতে চলিয়াছে। এই জাগরনের বিচিত্র ইতিহাসের সঙ্গে যে মহিমময়ী নারীর নাম আগাগোড়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত, আপনার হৃদয়রক্তে যিনি লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন যুগের জীবন-কাহিনী--তিনি আর কেহই নহেন, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসায়ন।
লেখিকা এই সংক্ষিপ্ত লেখার মাধ্যমে বেগম রোকেয়ার নাম উচ্চারণ করার সাথে সাথে সে যুগের একটি প্রতিচ্ছবি চমৎকার করে তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে।
শৈশব কাল বেগম রোকেয়া উনিশ শতকের শেষভাগে ১৮৮০ সালে রঙ্গপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অন্তর্গত পায়রাবন্দ নামক গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ধনেমানে, শিক্ষার বংশগৌরবে সাবের পরিবারের তুলনা ছিল না। রোকেয়ার পিতার নাম জহিরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী সাবের। পূর্বপুরুষের বিস্তার জায়গাজমি ও সম্পত্তি তাঁহারই অপব্যয়িতা ও বিলাসিতার মুখে তাসের ঘরের মতো উড়ে যায়। তিনি আরবী ও ফারসীতে বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। কিন্তু সে যুগের কুসংস্কার ও গোঁড়ামি তাঁহার মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় বাসা বেঁধে ছিল।
পায়রাবন্দ গ্রাম ও জমিদার বাড়ির পরিবেশ বর্ণনা করে বেগম রোকেয়া বলেছেন, ‘আমাদের এ নিবিড় অনণ্যবেষ্টিত বাড়ির তুলনা কোথায়? ...বাড়ির চতুর্দিকে গভীর বন, তাহাতে বাঘ, শূকর, শৃগাল-সবই আছে। আমাদের এখানে ঘড়ি নাই, সেজন্য আমাদের কোন কাজ আটকায় না। প্রভাতে আমরা ‘ঘু ঘু’, ‘বউ কথা কও’, ‘ওখুকি, ওখুকি’, ‘চোক গেল’ প্রভৃতি পাখির ভৈরবে আলাপে শয্যাত্যাগ করি। সন্ধাকালে শৃগালের ‘হুয়া হুয়া ক্যা হুয়া’ শব্দ শুনিয়া বুঝিতে পারি, মাগরেবের নামাজের সময় হইয়াছে। রাত্রিকালে কুরুয়া পাখির ‘কা-অ্যাক-কা-আক্-কু’ ডাক শুনিয়া বুঝিতে পারি, এখন রাত্রি তিনটা। আমাদের শৈশবজীবন পলীøগ্রামের নিবিড় অনণ্যে পরমসুখে অতিবাহিত হইয়াছে।’
পায়রাবন্দ রঙ্গপুর শহর থেকে বেশি দুরে অবস্থিত না হলেও শুধু যোগাযোগের অব্যবস্থার কারণে শিক্ষা-সংস্কৃতির দিক থেকে পশ্চাদপদ। ঊনবিংশ শতব্দীর শেষার্ধে আধূনিক জীবনের সকলপ্রকার সুযোগ-সুবিধা থেকে পায়রাবন্দ বি ত ছিল। সে সময় পায়রাবন্দ ছিল একটি অজ পাড়া-গাঁ। এই অজ পাড়া-গাঁয়ে বেগম রোকেয়ার শৈশব-কাল অতিবাহিত হয়েছে।
বেগম শামসুন নাহার তাঁর রোকেয়া- জীবনি গ্রন্থে বলেন--সাবের পরিবারের মেয়েরা ছিলেন ঘোর পর্দানশীন। আজ আমরা মনে করি আমাদের চলিবার পথে অনেক প্রতিবন্ধক, সমাজের অনেক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করিয়া আমাদের পথ চলিতে হয়; কিন্তু তুচ্ছ মনে হয় এ যুগের কুসংস্কার, যখন মনে পড়ে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগেকার--রোকেয়ার শৈশবের সেই আঁধার যুগের কথা। আজ আমরা হয়তো পুরুষের সামনে পর্দা করি। কিন্তু তখন কুলবালারা পর্দা করিতেন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া এবং বাড়ির চাকরাণী ছাড়া অন্য কোন মেয়ে মানুষের সামনে বাহির হইতেন না। যিনি যত বেশি পর্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশি পেচকের মতো লুকাইয়া থাকিতে পারিতেন তাঁহারই তত বেশি কুলগৌরবের পরিচয় পাওয়া যাইত।
সে যুগের মেয়েদের শুধু দেহই পর্দানশীন ছিল না-পাছে পর পুরুষের চোখে পড়িয়া তাঁহাদের হাতের লেখার বেপর্দা হয়, এই ভয়ে লেখাপড়া শেখাই ছিল তাঁহাদের পক্ষে একেবারে নিষিদ্ধ। নিজের জ্যেষ্ঠা ভগ্নির বাল্যশিক্ষার বিবরণ দিতে গিয়া রোকেয়া বলিয়াছেন- ‘চিরাচরিত প্রথা অনুসারে তাঁহাকে টিয়া পাখির মতো কোরান শরীফ ছাড়া আর কিছুই পড়িতে দেওয়া হয় না। কিন্তু তাহাতে তাঁহার আত্মার তৃপ্তি হইত না। ছোট ভাইয়েরা বাহিরে মুনশী সাহেবের কাছে ফারসী পড়িয়া আসিতেন-ভগ্নিকে শুনাইয়া ফারসী বয়েত আবৃত্তি করিতেন; তখন ভগ্নিও তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে বয়েতগুলি মুখস্ত করিতেন। ভাইদের বাংলা পড়া শুনিয়া তিনিও মুখে মুখে বাংলা অক্ষর যোজনা করিতেন, প্রাঙ্গণে মাটিতে দাগ কাটিয়া বাংলা লিখিতেন। একদিন তিনি গোপনে একটা বটতলায় পুঁথি লইয়া অস্ফুটস্বরে পড়িতেছিলেন।
সেই সময় হঠাৎ পিতা আসিয়া পড়েন। কন্যা অত্যন্ত ভয় পাইয়া ভাবিলেন এই বুঝি সর্বনাশ! কিন্তু না, পিতা কন্যার হাতে পুঁথি দেখিয়া রাগ করিলেন না, বনং ভয়ে মূর্ছিতাপ্রায় বালিকাকে কোলে লইয়া আদর করিলেন এবং সেই দিন হইতে একটু একটু বাংলা সাধু ভাষা পড়াইতে লাগিলেন। বাস্ আর যায় কোথা? যত মোল্লা মুরুব্বির দল একযোগে চটিয়া উঠিলেন-তাঁহাদের নিন্দা ও বাক্যজ¦ালায় অধীর হইয়া পিতা তাঁহার পড়া বন্ধ করিয়া দিলেন।’
রোকেয়া যে আবেষ্টনের মধ্যে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহা ছিল অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও কুসংস্কারে এমনই পঙ্কিল, এমনই বিষাক্ত! আর এর ভেতরেই কাটে তার শৈশবকাল।
ড. মাহবুবা রহমান: সাবেক বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ। লালমাটিয়া সরকারী মহিলা কলেজ, ঢাকা