মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিভ্রান্তি কতটা যৌক্তিক
মানবাধিকার আন্দোলনের ফসল যে বাংলাদেশ, সেখানে মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখাটাই নাগরিক সমাজের কাজ। আমরা বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখব।
২০২২ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার আগে মানবাধিকারের ধারণার গোড়ার কিছু কথা আলাপ সেরে নেওয়া যাক। ১৯৭৭ সালে কারেল ভাসেক মানবাধিকারকে তিনটি প্রজন্মে ভাগ করেন। ফরাসি বিপ্লবের স্লোগান দিয়ে এই তিন প্রজন্মকে চিহ্নিত করা হয়। ফরাসি বিপ্লবে ‘স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের স্লোগান তোলা হয়েছিল। প্রথম প্রজন্মের অধিকার হিসেবে স্বাধীনতাসম্পর্কিত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে চিহ্নিত করা হয়। আর্থসামাজিক সমতাসম্পর্কিত অধিকারগুলোকে দ্বিতীয় প্রজন্মের অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সবশেষে জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, পরিবেশগত অধিকার ইত্যাদিকে তৃতীয় প্রজন্মের ভ্রাতৃত্ব-সম্পর্কিত অধিকার হিসেবে চিত্রিত করা হয়।
অনেকেই মানবাধিকারের এই বিভাজনকে স্বীকার করতে চান না। ১৯৯৩ সালে ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অন হিউম্যান রাইটস আয়োজন উপলক্ষে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রস্তাব (৪৫/১৫৫) গৃহীত হয়। এই দলিলের প্রস্তাবনার ২য় অনুচ্ছেদে ঘোষণা করা হয় যে, ‘সব মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতাগুলো অবিভাজ্য এবং পরস্পর সম্পর্কিত’। যেমন, শিক্ষার অধিকার না থাকলে এবং ফেসবুক ব্যবহারের সুযোগ না থাকলে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেকটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। আবার, ধরুন, যখন শিক্ষার অধিকার দেওয়া হয়, কিন্তু তথ্য পাওয়ার অধিকার থাকে না বা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার সুযোগ থাকে না, তখন শিক্ষার অধিকার সমাজ ও রাষ্ট্রের খুব বেশি মঙ্গল সাধন করতে পারে না।
পরিশেষে, অমর্ত্য সেনের ক্যাপাবিলিটি অ্যাপ্রোচের আলোকে বলতে হয়, নাগরিকের স্বাধীন জীবনের লক্ষ্য পূরণে তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনমানের যে উন্নয়ন বাংলাদেশ ঘটিয়েছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি, এই উন্নয়ন সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে আরও প্রসারিত করতে হবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের কিছু ধারা নিয়ে নাগরিক সমাজের অনেকে আপত্তি তুলেছেন। আইনমন্ত্রী সেসব সংশোধনের ওয়াদা করেছেন। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, এ বছর এই আইনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হবে।
অমর্ত্য সেন তার বিখ্যাত বই ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম-এ (১৯৯৯) লিখেছেন, ক্যাপাবিলিটি অ্যাপ্রোচে স্বাধীনতার বিস্তৃতি একই সঙ্গে প্রাথমিক লক্ষ্য এবং মানব উন্নয়নের প্রধান উপায়। সুতরাং বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫-তে বর্ণিত মৌলিক চাহিদাগুলো মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত না হলেও অনুচ্ছেদ ৮ অনুযায়ী এ সব চাহিদা পূরণ ‘রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি’ হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে যত দ্রুত সম্ভব অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। যতক্ষণ না তা অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে, ততক্ষণ রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয় থাকার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ নিষ্ক্রিয় হয়ে বসেও নেই।
প্রাথমিক শিক্ষা প্রায় সব শিশুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। মাধ্যমিক শিক্ষায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা হয়েছে। শিক্ষাবিদদের অনেক দিনের দাবি ছিল একমুখী শিক্ষার। অবশেষে তা পূরণ হচ্ছে। ২০২২ সালে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী প্রায় ৩৫ কোটি বই পেয়েছে। এ বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৯ লাখ, যারা বিগত বছরের চেয়ে বেশি বই পাবেন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। দারিদ্র্য দূরীকরণে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে, শিক্ষা, শিক্ষায় লিঙ্গসমতা আনয়নে, শিশুমৃত্যু এবং মাতৃমৃত্যুর হার কমানো, ব্যাপক টিকা প্রদান ও ছোঁয়াচে রোগ প্রতিরোধে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অগ্রগতি লাভ করেছে। বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কাজ করে যাচ্ছে। পরিবেশগত অধিকার রক্ষায় ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে এবং ক্ষতিপূরণে বাংলাদেশকে সোচ্চার ভূমিকা রাখতে দেখা যাচ্ছে। এ ভূমিকা আরও জোরদার করতে হবে।
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের গুরুত্ব একবিন্দু না কমিয়েও বলা যায়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার ছাড়া একটি সক্রিয় ও সৃজনশীল নাগরিক সমাজের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। শিক্ষার অন্যতম অনুষঙ্গ দেশপ্রেম—দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা। এই শর্তকে উপেক্ষা করে বাকস্বাধীনতার চর্চা করা সম্ভব কি না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে সার্বিকভাবে বাংলাদেশে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার আরও প্রসারিত হোক এ আকাঙ্ক্ষা সব নাগরিকের। বিগত বছরে বিএনপি ১০টি বিভাগীয় সম্মেলন করেছে।
সংবিধানে প্রদত্ত রাজনৈতিক অধিকারগুলো তারা উপভোগ করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে, দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা গঠনমূলক রাজনীতি করবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এর বিকল্প নেই। এর অন্যথা হলে, বিদেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে। এর কিছু উদাহরণ ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, যা অনভিপ্রেত। আমরা নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তর্কবিতর্ক দেখতে চাই, বিভাজন নয়, দেশমাতৃকার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা তো নয়ই। তা ছাড়া দেশের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘু কমিশনের ওয়াদা করেছে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, তারা তাদের কথা রাখবে। আশা করি, অন্যান্য রাজনৈতিক দলও সরকারকে এ ব্যাপারে সমর্থন দেবে এবং জনগণের মধ্যে সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেবে।
ড. মিজানুর রহমান: সাবেক চেয়ারম্যান, মানবাধিকার কমিশন
আরএ/