গ্রামীণ রূপান্তরের অন্যতম অনুষঙ্গ কৃষি
উন্নয়ন বলতে অনেকে শহরের রূপান্তরকেই বুঝিয়ে থাকেন, কিন্তু উন্নয়ন ধারণাটি এতটা সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার হয় না। উন্নয়ন শব্দটি গ্রামের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। দুই দশক ধরে আলোচনায় গ্রামের অনুপস্থিতি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একসময় আমাদের গবেষণার অন্যতম ক্ষেত্র ছিল গ্রাম। এখনো আছে, তবে গুরুত্ব কমেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বর্তমান সময়ে এসে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে গ্রামের রূপান্তর সম্পর্কে ধারণা লাভ করাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। গ্রামের রূপান্তরকে বাদ রেখে শুধু শহরের রূপান্তর দিয়ে উন্নয়নের আলোচনা পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে না।
বর্তমানে একটা বাস্তবতা তৈরি হয়েছে যেটাকে আমি বলছি ‘নিউ রুরাল’ বা ‘নতুন গ্রামীণ’। গ্রাম নিয়ে জনমানসে এক ধরনের জ্ঞানের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। জ্ঞানের ঘাটতি বেশ কয়েকটা জায়গাতেই রয়েছে। যেমন গ্রামের শ্রেণি কাঠামোর বিবর্তন। আগে মাতব্বর, মোড়ল, জোতদার, ভূমিহীন, ক্ষুদ্র কৃষক এদের নিয়েই সাজানো ছিল গ্রাম। গ্রামীণ মধ্যবিত্তেরও একটা ধারণা ছিল। এসব ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। গ্রাম নিয়ে আলোচনায় প্রথমেই এর শ্রেণি কাঠামোর বিবর্তনটা কেমন হয়েছে, তা দেখা প্রয়োজন। কিন্তু এসব বিষয়ে তেমন গবেষণা হয়নি।
গ্রামীণ রূপান্তরের অন্যতম অনুষঙ্গ গ্রামীণ কৃষি। বিষয়টি নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে বটে তবে তাতে রূপান্তরের সার্বিক চিত্র পাওয়া যায় না। যেমন কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। শস্য, সবজি, ধান, মাছ উৎপাদন নিয়েও গবেষণা আছে। কিন্তু কৃষির রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণি কাঠামোয় কেমন বিবর্তন হলো, তা নিয়ে গবেষণার ঘাটতি রয়েছে। একসময় উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃষি এবং গ্রাম সমার্থক ছিল। গ্রাম বললেই চোখের সামনে কৃষির বিষয়টি ভেসে উঠত। এখন নতুন রূপান্তরিত গ্রামের সঙ্গে কৃষি সমার্থক নয়, এটা আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু এর ব্যাখ্যাটা কী? এখানেও জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে।
গ্রামীণ কৃষির পরিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে উচ্চ ফলনশীল জাতের সম্প্রসারণ। এটি গ্রামীণ পরিবর্তনের একটা অনুষঙ্গ। এর মধ্যে উচ্চ ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, একাধিক ফসল উৎপাদন প্রভৃতি মিলে কৃষির রূপান্তর ঘটেছে। আগে আমন ও তারপর কিছুটা আউশ ধান উৎপাদনই ছিল গ্রামীণ কৃষির মডেল। এখন আমন, আউশ, বোরোর পাশাপাশি কিছু সবজি, ফল আবাদ হচ্ছে। কৃষির পরিবর্তনের শুরু পূর্বাঞ্চল থেকে। মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে সেখানে কৃষির বিবর্তন শুরু হয়। চাঁদপুরসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় এ রকম কিছু প্রকল্প ছিল। আশির দশক থেকে কুমিল্লা মডেল কৃষির উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। এরপর দেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষি উৎপাদনে পরিবর্তন আসে। সেখানে মূলত গভীর নলকূপ দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির সেচের মাধ্যমে বোরোভিত্তিক চাষাবাদ শুরু হয়। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তরাঞ্চলের কৃষির পরিবর্তনে বড় ধরনের প্রভাব রাখে।
এখন কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। পদ্মার ওপারে খুলনা থেকে বরিশাল-ভোলা পর্যন্ত কৃষির সম্ভাবনা রয়েছে। পদ্মা সেতু তৈরি হয়েছে, এখন সেখানে কেমন পরিবর্তন হবে, সেটাই দেখার বিষয়। গ্রামের কৃষির পরিবর্তনকালকে সবুজ বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করা হয়। সবুজ বিপ্লবের দুটি ঢেউ এসেছে বাংলাদেশে। একটা পরিবর্তন হয়েছে ভূউপরিস্থ পানিভিত্তিক প্রকল্পের মাধ্যমে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির মাধ্যমে। দক্ষিণাঞ্চলে এটি পরিষ্কার না কোন কোন প্রযুক্তির মাধ্যমে সেখানে কৃষির বিবর্তন ঘটবে, কিন্তু এ দুই পর্যায়ে ক্ষুদ্র কৃষক টিকে গেছে। কৃষি থেকে ক্ষুদ্র কৃষক উত্খাত হয়ে যায়নি।
সবুজ বিপ্লবের ভেতর তারা এক ধরনের অবস্থান করেই পুরো প্রক্রিয়ার অংশীদার হয়েছে। এখন ক্ষুদ্র কৃষিতে নতুন যে পরিবর্তন হচ্ছে সেগুলো কি কৃষির রূপান্তরের পরিবর্তন, না এটি গ্রামীণ পরিবর্তন? যেখানে শহর ক্রমে গ্রামে প্রবেশ করছে। অকৃষি খাত গ্রামে নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। গ্রাম আর কৃষির সমার্থক বিষয়টি এখন অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ বাস্তবতায় ক্ষুদ্র কৃষকের ভবিষ্যৎ কী? বাংলাদেশ মূলত ক্ষুদ্র কৃষকের দেশ ছিল বা এখনো আছে। এর ভবিষ্যৎ কী আমরা তা জানি না, এখানেও জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। এটাও চমকপ্রদ ঘটনা যে আমাদের নিরক্ষর কৃষক সমাজ দ্রুতই প্রযুক্তিকে গ্রহণ করে এগিয়েছে। প্রযুক্তি গ্রহণ করে কৃষির রূপান্তর মূলত নিরক্ষর কৃষকই করেছে। সাক্ষরতার হার গ্রামীণ পর্যায়ে খুবই কম। প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতার হার গ্রামীণ পর্যায়ে কম। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে থাকা কৃষকই কৃষির রূপান্তরে বড় ভূমিকা রেখেছে। তারা প্রযুক্তি গ্রহণ করেছেন, উৎপাদন বাড়িয়েছেন।
কুমিল্লার দাউদকান্দিতে গিয়ে দেখতে পেলাম চাষাবাদের আধুনিক মডেলগুলো এখন গ্রামেও উপস্থিত। যেমন প্লাবনভূমিতে মত্স্য চাষ, যেটা সাময়িক সময়ের জন্য হয়। বর্ষার সময়ে বিস্তৃত এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। সেখানে সম্মিলিতভাবে মাছ চাষ হচ্ছে। পানি নেমে গেলে সবাই আবার যার যার জমি চাষাবাদ করছে। পানিতে তলিয়ে গেলে কারো ব্যক্তিগত প্লটের সীমানা থাকে না, তখন তারা কীভাবে একত্রিত হয়ে মাছ চাষ করছেন, তাও পর্যালোচনার বিষয়। তারা সমবায় ভিত্তিতে মাছ চাষ করছেন, কিন্তু সেটি পুরোনো মডেল নয়। এটা এক ধরনের কার্যকর সমবায়। এক্ষেত্রে পরিবর্তনের অর্থটা কী? এটি কি শুধুই বাজারের প্রভাব?
গ্রামীণ বিবর্তনের শুরু অকৃষি বা কৃষিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড দিয়ে। ক্ষুদ্রঋণ এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের কার্যক্রম এখান থেকেই শুরু হয়েছে। তারা ঋণ দিত বটে, কিন্তু ঋণ নিয়ে গ্রামের মানুষ কী করছে এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কী পরিবর্তন হয়েছে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায় না। এগুলো কি শুধু অর্থনৈতিক বিষয় না সামাজিক বিষয়ও রয়েছে? গ্রামের রূপান্তরের আরেকটা দিক হলো, গ্রামীণ যানবাহনের বৃদ্ধি। মানুষ ও পণ্য পরিবহনে যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে। ভ্যানগাড়িতে ইঞ্জিন সংযোজন করে তা ব্যাটারিতে চালানো হচ্ছে। নৌকা এখন ইঞ্জিনচালিত, সেটি আবার দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মাণ করা হয়েছে। দোকানের সংখ্যা বিপুল আকারে বেড়েছে। চাহিদা বেড়ে ওঠায় শহরের পণ্য এখন গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে।
গ্রামীণ রূপান্তরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিবারের অর্থনৈতিক ভিত্তি। এমন যদি দেখা যায়, একজন কিছুটা কৃষি করছে, কিছুটা অকৃষি খাতে কাজ করছে, আবার তার কিছু সম্পদ শহরে আছে, তাহলে তাদের আমরা কী বলব? সার্বিকভাবে শহর-গ্রাম, কৃষি-অকৃষি ইত্যাদি সম্পর্কগুলো বোঝার ক্ষেত্রে জ্ঞানের ঘাটতি আছে। এটি বাস্তবতা।
এখন প্রশ্ন আসছে নগর ও গ্রামের সম্পর্কটা কী হবে? গ্রাম ও নগর কি সমার্থক হয়ে যাবে? এ কথা স্বীকার করতেই হবে, গ্রামে নগরায়ণের প্রভাব পড়ছে। তবে তার রকমভেদ রয়েছে। রেমিট্যান্স প্রসঙ্গে জ্ঞানের ঘাটতি আছে। মূলত কারা যায় বিদেশে? গ্রামের লোকজন ও শহরের লোকজন বিদেশ যাচ্ছে। কিন্তু রেমিট্যান্স বেশি আসছে গ্রামেই। রেমিট্যান্সের ফলে গ্রামের রূপান্তর কেমন হলো? এক্ষেত্রেও জ্ঞানের ঘাটতি আছে। রেমিট্যান্সের ফলে গ্রামে এক ধরনের নাগরিক চাহিদা তৈরি হয়েছে। রাস্তাঘাট তৈরি হচ্ছে। গ্রামে এখন কমিউনিটি সেন্টার আছে, ১০০ জন দর্জি বসে ফ্যাশনেবল পোশাক বানাচ্ছে, গ্রামে এখন রেস্টুরেন্ট রয়েছে, আছে বিউটি পার্লার। এগুলোর অর্থনীতি যেমন আছে, তেমনি আছে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিকও। নগরের বিদ্যমান সুবিধার চাহিদা গ্রামেও তৈরি হয়েছে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: নির্বাহী চেয়ারম্যান, পিপিআরসি ও চেয়ারম্যান, ব্র্যাক
এসএন