মূল্যস্ফীতির অভিঘাত মোকাবিলায় উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে
আমরা করোনা ভালোভাবে মোকাবিলা করেছি। এবারে মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকটের মতো সমস্যা এসেছে। প্রথম কথা হলো, কোভিড নেই—এ কথা আমরা পুরোপুরি বলতে পারব না। যদিও বাজেটে মনে করা হচ্ছে আমরা কোভিড থেকে পরিত্রাণ পেয়ে গেছি। যেখানে বাজেটটির নামই দেওয়া হচ্ছে কোভিড পরবর্তী বাজেট।
গণমাধ্যমের খবরে আসছে কোভিড সংক্রমণ আবারো বাড়ছে। কোভিড-বিষয়ক স্বাস্থ্যবিধি ও সব ধরনের সতর্কতা পালন করতে হচ্ছে। সুতরাং আমরা একেবারে নিশ্চিত হতে পারছি না। কোভিড থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু পুরোপুরি নয়।
এদিকে কোভিড পার হতে না হতেই নতুন অনেক সমস্যা এল। যেমন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের আগেই যখন বিশ্বের সর্বত্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কিছুটা বাড়তে শুরু করে তখন সরবরাহ ব্যবস্থায় একটা বাধা সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে পণ্য চলাচলের খরচ বেড়ে যায়। এর ওপর যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে সবকিছুরই দাম অসম্ভব রকম বেড়ে গেল। এর অভিঘাত আমাদের দেশেও পড়েছে। আমাদের দেশে জ্বালানি তেল শতভাগ আমদানির ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যও আমদানি করি আমরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ অসম্ভব রকম হারে বেড়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর এর চাপ আরও অসমভাবে পড়েছে। কারণ কোভিডে যারা চাকরি হারিয়েছেন, তারা কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও আগের মতো তাদের অনেকেরই আয় নেই কিংবা সঞ্চয় যা ছিল তাও শেষ হয়েছে। সব মিলিয়ে তাদের অবস্থা সঙ্গিন। আর দরিদ্রের অবস্থা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না।
চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ডলারের বাজার স্থিতিশীল করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা। প্রথম বিষয় হলো মূল্যস্ফীতি। এটিই এখন সবচেয়ে বড় উদ্বেগ। আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এটি ৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। যদিও সংখ্যা নিয়ে একটা বিতর্ক আছে। বাজারে যে পণ্যের মূল্য পরিস্থিতি, তার সঙ্গে এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। টিসিবির দৈনিক পণ্যমূল্যের তালিকা দেখলে দেখা যায়, কোনো কোনো নিত্যপণ্যের দাম ৩০-৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। সুতরাং মূল্যস্ফীতির সরকারি হিসাবের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।
সবচেয়ে বড় বিষয়, এখনকার সমস্যাটা বিশ্বে কতদিন চলবে তা অনেকটা অনিশ্চিত। তবে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, এটা চলবে আরও কিছুদিন। বিশ্বের অনেক দেশই এখন মন্দার দিকে যাচ্ছে। একটা স্ট্যাগফ্লেশন হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্থাৎ একদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, অন্যদিকে প্রবৃদ্ধি কমবে। বলা চলে, একটা কঠিন অবস্থা তৈরি হতে পারে, যা বিশ্ব সত্তরের দশকের পরে দেখেনি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় অর্থনীতিও ২০২৩ সাল জুড়েই চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকবে। এখান থেকে আমরা কবে মুক্তি পাব তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
আইএমএফ তাদের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন ৬ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়েছে। বিশ্বব্যাংকও তার প্রাক্কলন কমিয়েছে। তাহলে আমরা যে ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মূল্যস্ফীতি বা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব করছি তা কিসের ভিত্তিতে করছি। আমরা যদি বলেই থাকি আমদানি মূল্যস্ফীতিই এখানে মূল, তাহলে সেটিই তো মূল্যস্ফীতির অনেকখানি নির্ধারণ করবে। আবার দেখুন, শুধু আমদানি মূল্যস্ফীতি নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যেরও দাম বেড়েছে।
আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনার এত দুর্বলতা এবং কিছু বাজারে একটা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এমন অন্যায়ভাবে দাম বাড়িয়ে দেয়, সেটা ভোক্তাদের ওপর ব্যাপক আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে। আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়লে তারা সেটির দাম বাড়িয়ে দেন। আবার দেশীয় পণ্যেরও দাম আরেক দফা বাড়ে। এর কারণ হলো বাজারে সুশাসন নেই। আমদানীকৃত পণ্যের দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। সুতরাং বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপ থাকবেই। অর্থমন্ত্রী ৫ দশমিক ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি কীভাবে নির্ধারণ করেছেন তা একেবারে বোধগম্য নয়।
যদি মনে করা হয়, সারাবিশ্বে যাই হোক না কেন আমরা প্রবৃদ্ধি চালিয়ে যাব, এটা একেবারেই অমূলক। কারণ আমাদের অর্থনীতি এখন বিশ্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা তো বলছি, বিশ্বের সঙ্গিন অবস্থার কারণে আমাদের এখানেও তার প্রভাব পড়বে এবং সেটিই হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হলো। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমরা যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাই তাহলে প্রথম কাজ হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো। এক্ষেত্রে কিছুটা করছাড় দেওয়া গেলে মূল্যস্ফীতি একটু নিয়ন্ত্রণ করা যেত। সেখানে সম্পূর্ণ করছাড় দিচ্ছি না আমরা। মাত্র দু-একটা পণ্যের ওপর করছাড় দেওয়া হচ্ছে। ভোজ্যতেলের ওপর আগে কিছুটা কর কমানো হয়েছিল। কিন্তু খুব একটা সুবিধা হয়নি। আরেকটা বিষয় হলো, ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিনের দাম বাড়ার ফলে অনেকে কিন্তু পাম তেল ব্যবহার করছে। এর ওপর করছাড় হয়নি। তাই বাজেটের মধ্যে মোকাবিলার যে আর্থিক পদক্ষেপ তা দেখা যাচ্ছে না। ফলে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির চাপটা থাকবে।
ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি
আরএ/