‘গরুপ্রেম দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইয়া হাঁটা দিই’
১৪ ফেব্রুয়ারি প্রেম দিবসে গরুকে জড়াইয়া ধরিবার নিদান দিয়াছে জাতীয় পশু কল্যাণ বোর্ড। প্রেম দিবসে যখন দিকে দিকে মানবজাতি ভার প্রেমাস্পদকে আলিঙ্গন করিবে, তখন দিকে দিকে গোপ্রেমী মানুষকে গরুকে জড়াইয়া ধরিতে দেখা যাইবে। আহা, এই দৃশ্য কল্পনা করিতেও কী ভালোই না লাগিতেছে। ওইদিন দেশের যাবতীয় গরুর খাটালে ভিড় জমিবে গোভক্তদের। তাহাদের আলিঙ্গন খুশি হইয়া গরুরাও চার পা তুলিয়া পাল্টা আলিঙ্গন করিবে। সব মিলিয়া তাহাতে কী প্রেমরসই না সিঞ্চিত হইবে। ভাবিয়া যারপর নাই পুলকিত হইতেছি।
এমনিতেই দেশে এক শ্রেণির মানুষ গোপ্রেমে অন্ধ। দেশের মানুষ না খাইতে পারুক, তো তাহাতে ওই গোপ্রেমীদের কিছু যায় আসে না| কিন্তু তাহারা গরুকে খাওয়াইতে ব্যস্ত থাকেন পথে রোজই এক ক্ষুদ্র মাঠে বাঁধা কিছু গরুকে খাদ্য ভক্ষণ করাইতে দেখি এক ব্যক্তিকে। তাহার পর গরুগুলোকে তিনি নমস্কারও করেন। তাহার হাতে বিস্কুট, কলার ঠৌঙা দেখিয়া পথের কিছু অভুক্ত শিশু ছুটিয়া আসে। কিন্তু ওই গোপ্রেমিককে ওই শিশুদের দিকে তাকাইতেও দেখি না। তাহার গরুপ্রেম দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইয়া হাঁটা দিই।
জাতীয় পশু কল্যাণ বোর্ডের ওই বিজ্ঞপ্তি দেখিয়া আপিসের পথে নিত্য দৃশ্যমান ওই গোপ্রেমীর মতো হাজার হাজার প্রেমিকপ্রবর দারুণ উল্লসিত হইয়াছেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জানিতে পারিলাম,পাড়ায় পাড়ায় গরুকে আলিঙ্গন করিবার মহোৎসব পালনের জন্য কমিটি গঠনের তোড়জোড় হইতেছে। বিজেপি, সঙ্ঘ পরিবারের লোকজন এখন দারুণ ব্যস্ত। অনেক রাজ্যে এই প্রেম দিবসে এক শ্রেণির মানুষ প্রেমিক-প্রেমিকা পিটানোর জন্য মুখাইয়া থাকে। তাহাদের মতে, প্রেম দিবস নাকি ভারতীয় ঐতিহ্যের বিরোধী। তাই রাস্তাঘাটে, পার্কে যুবক যুবতী, মহিলা পুরুষকে একত্রে দেখিলেই ওই বীরপুংগবদের বীররস জাগিয়া ওঠে। এইবার পশু কল্যাণ বোর্ডের বিজ্ঞপ্তি জারি হইবার পর তাহাদের দায়িত্ব আরও বাড়িয়া গিয়াছে। রাস্তায় যুবক যুবতীকে একান্ত দেখিলেই তাহাদের পিটাইতে হইবে। আবার গরুকেও আলিঙ্গন করিতে হইবে।
এমনিতেই এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে দিলীপ ঘোষের মতো কিছু বিজেপি নেতা গরুর দুধে সোনা খুঁজিয়া পাইয়াছেন। কেহ কেহ আবার করোনাকালে গোমূত্র খাইলে তাহা সারিয়া যাইবে বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। কোথাও কোথাও তো গোমূত্র পান করিবার জন্য মণ্ডপ খাটাইয়া উৎসব হইয়াছিল। যোগীরাজ তো তাহার রাজ্যে গরুদের পেনশন দেবারও প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন গত ভোটের আগে।
তবে সবকিছুকে ছাপাইয়া গিয়াছে পশু কল্যাণ বোর্ডের ওই বিজ্ঞপ্তি। তাহাতে গরুকে ভারতীয় সংস্কৃতির মেরুদণ্ড বলা হইয়াছে। পশ্চিমা ভাবধারায় প্রভাবিত হওয়ার ফলে ভারতে নাকি বৈদিক সংস্কৃতি লুপ্ত হইতে বসিয়াছে। এমন কথাও বলা হইয়াছে।
আসলে কিছু একটা লইয়া মাতিয়া থাকিতে হইবে। আদানি গোষ্ঠীকে লইয়া যখন বিজেপি নানা প্রশ্নের মুখে, তখনই গরুকে আলিঙ্গন করিবার বাসনা পাইয়া বসিল কেন্দ্রের শাসকদলের। দেশে বেকার বাড়িতেছে, দ্রব্যমূল্য লাগামছাড়া। চারিদিকে শুধুই হাহুতাশ। তাহা হইতে দৃষ্টি ঘুরাইতেই এই গোপ্রেম কি না, কে জানে।
তবে আবারও বলিতেছি, ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রেম দিবস, থুড়ি গো আলিঙ্গন দিবসে কী হইতে চলিয়াছে, তাহা ভাবিয়া আমার রাতের ঘুম ছুটিয়াছে। শুধু একটাই পরামর্শ, দেখিবেন, গরুকে আলিঙ্গন করিবার সময় সে যেন শিং বাগাইয়া গুঁতাইতে না আসে। সে গুঁতাইয়া দিলে আবার হাত পা ভাঙিয়া ঘরে বসিয়া থাকিতে হইবে। তখন আবার না কেহ নিদান দেয়, এক কাপ গোমূত্র পান করিলেই আপনার ব্যথা বেদনা সব দূর হইয়া যাইবে। যাই হউক, শুভ গো আলিঙ্গন দিবসের অনেক শুভেচ্ছা রহিল।
‘গো হাগ ডে’, তথা গোমাতাকে আলিঙ্গনের দিন। প্রেমদিবস বলে পরিচিত ১৪ ফেব্রুয়ারিকেই জাতীয় পশুকল্যাণ বোর্ড সেই গো-প্রেমের জন্য নির্দিষ্ট করেছে। বুধবার সেই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই টুইটার-ট্রেন্ড, ফেসবুক-হোয়াটসআ্যাপে পোস্ট থেকে ইনস্টাগ্রাম স্টোরির হাজারো তামাশাঁ- বৃহস্পতিবার দিনভর গো-হাগের সোহাগে মজে রইল নেটগাড়া। এমনিতেই এখন ভ্যালেন্টাইনস সপ্তাহ চলছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডে দিয়ে তার শেষ হওয়ার কথা। তার মাঝে চর্চার এই নতুন খোরাক গেয়ে মেতেছেন নেট-নাগরিকেরা। ‘ভারতীয় সংস্কৃতির মেরুদণ্ড গরুকে বলে বিজ্ঞপ্তিতে গরুকে আলিঙ্গনের যুক্তি দেওয়া হলেও তাকে কটাক্ষ করে মন্তব্য পাওয়া গিয়েছে, ‘কিন্ত গোমাতার এই আলিঙ্গনে সম্মতি রয়েছে কি না তা কী করে জানা যাবে?’ আর এক জনের টিপ্পনী, ‘অর্থনীতির যা অবস্থা, গোলাপ কেনার থেকে অন্তত গরুকে জড়িয়ে ধরা পকেট বাঁচাতে সহায়ক হবে।’ প্রবল ছড়িয়েছে প্রেমদিবসে ফের মুক্তি পেতে চলা টাইটানিক’-এর ডেকে গোমাতাকে হাজির করে কোনো শিল্পীর আঁকা কার্টুনও। কারও চিন্তা, ‘যদি গুঁতিয়ে দেয়?’
এমনকি পশ্চিমি দুনিয়া থেকে অনুপ্রাণিত ভ্যালেন্টাইনস ডে নিয়ে তীব্র আপত্তি রয়েছে গেরুয়া শিবিরের। তার উপর হিন্দুত্ববাদী বহু সংগঠনই বরাবর ১৪ ফেব্রুয়ারিতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের কোনো অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখা গেলে তা ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’ রন বিরোধী বলে যুগলদের ‘সবক শেখানোর’ হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এ বার গরুকে ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গনে আবদ্ধ বলা হলে তারা কী করবে সেই কটাক্ষও ছুড়ে দিয়েছেন অনেকে। একটি ভিডিয়ো ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে, যাকে দেখা যাচ্ছে নেতাগোছের এ ব্যক্তি একটি গরু কাছে গিয়ে প্রণাম করতে চাইছেন এবং গরুটি পেছনের পা দিয়ে লাথি ছুড়ে দিচ্ছে। নেটপাড়ায় তা নিয়ে কটাক্ষ ভাসছে, ‘ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঘনিষ্ঠ হতে গেলে কিন্তু এমন শাস্তি অপেক্ষা করে আছে।’
গোরক্ষার নামে গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন চল্লিশেরও বেশি ভারতীয়। সেই আশঙ্কাও সমাজমাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন অনেকে। অনেকের প্রশ্ন, একটি বিশেষ ধর্মে গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রাণীকে কোনাে জাতীয় বোর্ড ধর্মনিরপেক্ষ দেশে এভাবে বাড়তি গুরুত্ব দিতে পারে কি?