দেশের মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত
দেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলার অবকাশ নেই। আমি বরং এভাবে যদি বলি যে, সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীদের কথায় মনে হয়, তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে চান এবং সেক্ষেত্রে তারা উদার, মহান। সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীদের ভাষ্য হলো, নির্বাচন বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই হবে এবং তা সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হবে।
আওয়ামী লীগ একটানা কয়েক মেয়াদে ক্ষমতায়। তাদের দাবি, ক্ষমতার ধারাবাহিকতা থাকায় দেশের অনেক উন্নতি করেছে। মানুষের গড় আয় ও আয়ু দুটোই বেড়েছে। মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজস্ব অর্থায়নে তারা পদ্মা সেতু করে দেখিয়ে দিয়েছে, ‘আমরাও পারি।’ একইভাবে আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জটি নিয়ে দেখাক, তাদের আমলে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনও সম্ভব।
আমরা যা দেখছি, সেখানে নিরপেক্ষ নির্বাচনের অবস্থা তো দেশে নেই। সবক্ষেত্রে সরকারের অনুগত লোক বসিয়ে রাখা হয়েছে। এরা আদেশ-নিষেধ পালনের জন্য বসে আছে, দায়িত্ব পালনের জন্য নয়। কার্যত ২০১৮-র পরে দেশে নির্বাচন বলে কিছু নেই। শৈশবে পাকিস্তানে আমরা সত্যিকার ভোট দেখিনি, দেখেছি বেসিক ডেমোক্র্যাসি। এখন আমাদের উত্তর প্রজন্মও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সামরিক ও বেসামরিক চক্র নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ছয় দফা এক দফায় পরিণত হয়। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এরপর আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানও পেলাম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং সমর্থন দিয়েছেন বলেই পদ্মা সেতু নির্মাণে সমর্থ হয়েছি। যারা বাধা দিয়েছিল, তাদের একটা উপযুক্ত জবাব দিয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু করে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত শক্তিশালী করেছেন, সন্দেহ নেই। স্বাভাবিকভাবে মানুষ চাইবে গণতন্ত্রের ভিতটিও শক্তিশালী হোক।
কীভাবে সেটা সম্ভব? একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। সংবিধান অনুযায়ী জনগণ বাংলাদেশের মালিক। নির্বাচনই হলো সেই মালিকানা নির্ধারণের প্রধান অবলম্বন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, নির্বাচন প্রশ্নে সরকার সংবিধানের এক সুতাও বাইরে যাবে না। প্রশ্নটি বাইরে বা ভেতরে যাওয়ার নয়। প্রশ্নটি হলো একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করতে সরকারের সদিচ্ছা আছে কি না।
রাজনীতিকেরা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী সংবিধান, নির্বাচন, গণতন্ত্র, সংসদীয় ব্যবস্থা ইত্যাদির ব্যাখ্যা দেন। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কোনো আদর্শ উপায় নয়, চোর ঠেকানো। আমরা যখন সত্যিকারভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে পারব, তত্ত্বাবধায়কের প্রয়োজন হবে না। যেখানে দলীয় সরকার প্রশাসন থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে ইভিএম— সবকিছু নিজের দখলে নেন, সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া বিকল্প কী? উচ্চ আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে (যদিও সেই রায়ে দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা বলা হয়েছিল) তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করার পর আওয়ামী লীগেরই দায়িত্ব ছিল দলীয় সরকারের অধীন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেখানো। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তারা সেটি পারেনি।
আওয়ামী লীগ সাড়ে ১৩ বছর একটানা ক্ষমতায়। তাদের দাবি, ক্ষমতার ধারাবাহিকতা থাকায় দেশের অনেক উন্নতি করেছে। স্বল্প আয়ের দেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাচ্ছে। মানুষের গড় আয় ও আয়ু দুটোই বেড়েছে। মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজস্ব অর্থায়নে তারা পদ্মা সেতু করে দেখিয়ে দিয়েছে, ‘আমরাও পারি।’ যে দল বিশ্বব্যাংকের বিরোধিতা সত্ত্বেও পদ্মা সেতু করতে পারে, সেই দল কেন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে না? কাজেই একইভাবে আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জটি নিয়ে দেখাক, তাদের আমলে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনও সম্ভব।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ
এসএন