ভালো শিক্ষক ছাড়া ভালো শিক্ষার্থী তৈরি সম্ভব নয়
নতুন বছরে নতুন শিক্ষা পাঠ্যক্রমে নতুন একটি আশার কথা হলো, ইতোমধ্যে ১ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যক্রমে পাইলটিং সম্পন্ন হয়েছে যেটি অত্যন্ত ভালো এবং যেখানে সৃজনশীল বিষয় আছে এবং পরীক্ষার চাপ কম আছে।
মুখস্ত না করে কীভাবে বিষয়গুলো ভালোভাবে বোঝা যায় সেভাবে বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হচ্ছে। অনেক রকম ভালো উপকরণ আছে। সমস্যা হলো যারা শিখাবেন, তারা প্রস্তুত হননি এখনো। তাদের প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত সুফল আসবে না। আমাদের চেষ্টা হচ্ছে, তাদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে মাপের শিক্ষক আমাদের প্রয়োজন সেই মানের শিক্ষক আমাদের বেতন ব্যবস্থার মধ্যে পাওয়া যাবে না। এটি আশা করা খুবই বাতুলতা। আমি আশা করি, নতুন বছরে সরকার এবং যারা কর্তাব্যক্তি আছেন তাদের ভেতর এই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হবে। সরকারও শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করবে। এটি অনেকেই মুখে বলেন কিন্তু মনে কতটা ধারণ করেন সেটি আমরা জানি না। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ এখনো জিডিপির দুই শতাংশের ধারে কাছে ঘুরছে।
সেখানে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ক্রমান্বয়ে উন্নতি করছে। আমরা যদি জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি যেতে না পারি, বলা বাহুল্য ৭৪ সালের যে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন তৈরি হয়েছিল, সেখানে সুপারিশ ছিল। কাজেই শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় অর্থায়নের যোগান দিতে পারব না এবং না দিতে পারলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও পশ্চাদপদ থেকে যাবে। ভালো শিক্ষক ছাড়া কখনো ভালো শিক্ষার্থী তৈরি হবে না।
ভালো পাঠ্যক্রমকে সঠিকভাবে রূপান্তর করা আমাদের শিক্ষাক্রমের মধ্য দিয়ে, শিক্ষণ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে সে কুশলতা ও দক্ষতার প্রয়োজন, সেটি অল্প বেতনের প্রাথমিক শিক্ষক দ্বারা তৈরি হবে না। নতুন বছরে আমাদের আশাবাদ, একটি সুযোগ যেহেতু আমাদের হাতে আছে এবং সেটি প্রমাণ করার সক্ষমতা আমাদের আছে। বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করে আমরা যদি ৭০-৮০ হাজার টাকা দিই একজন শিক্ষককে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীও শিক্ষকতা পেশায় উৎসাহিত হবে। বিশেষ করে মেয়েরা যদি বেশিমাত্রায় অংশগ্রহণ করে সেটি হবে আশাব্যঞ্চক এবং ভালো প্রশিক্ষণ যদি তারা পায় সেটি আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
আমি জানি না নতুন বছরে সেটি সম্ভব হবে কি না। নির্বাচন আসবে ভবিষ্যৎ আশা নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা আমরা শুনব। তবে সেটি কত খানি আন্তরিক সেটি ভাবার বিষয়। আমাদের শ্রেণিকক্ষকে আরও অনেক বেশি উন্নত করতে হবে।
প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ যেন না থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। দুই বছরের কলেজ শিক্ষায় বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীরা রাজনীতির শিকার হয়। যারা রাজনৈতিকভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে তাদেরকে কোনোভাবেই স্থান দেওয়া উচিত নয়। শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজনীতির নামে অপরাজনীতি দূর করতে হবে।
আমি একটি কথা বলতে চাই যে, আমাদের শিক্ষার শত্রুরা কিন্তু ঘরের ভেতরেই। নোট বই গাইড বই টিউশন বাণিজ্য যারা করেন, তারা চাইবেন না যে তাদের ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যাক। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সংস্কৃতিতে আমাদের বেশ জোর দিতে হবে। সংস্কৃত শিক্ষা যেটি মানুষকে অগ্রগামী করে। সেই সংস্কৃতি শিক্ষা এবং শিক্ষার একটি আলাদা সংস্কৃতি আছে। দুটির একটি সমন্বয় না ঘটালে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কোনো উন্নতি হবে না।
একটি খেলার মাঠ যদি না থাকে স্কুলে তাহলে বাচ্চারা কিন্তু কোনোদিনই সুস্থ স্বতস্ফূর্তভাবে বেড়ে উঠবে না। অনেক কিছুই ব্যাপার আছে যেগুলো আমাদের ভাবতে হবে। সেগুলো যদি আমরা শুরু না করি তাহলে আমরা এগোতে পারব না। আগের সেই মান্ধাতা আমলেই সব চলছে। প্রশাসনে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি কিন্তু এক্ষেত্রে শিক্ষকদের অনেক দূরে রাখা হচ্ছে। অথচ প্রশাসন শিক্ষকদের দ্বারাই শিক্ষিত হচ্ছে। কাজেই শিক্ষায় নতুন উদ্যোগ চাই। শুধু তৈরি পোশাক আর বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি করে আমরা জীবনেও সামনের দিকে যেতে পারব না। কাজেই শিক্ষাক্ষেত্রে সুনজর না দিলে আমরা আরও পিছিয়ে থাকব।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক