ভয় দূর করে দুর্নীতি রোধ করতে হবে
আমাদের সমাজে দুর্নীতির যে চিত্র অর্থাৎ এটি যেভাবে আখড়া গেড়ে বসেছে সেটি কোনোভাবেই সুখকর নয়। এর কারণ হলো, যারা দুর্নীতি করেন তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। তাদের কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে যেটি লক্ষ্যনীয়, ছোট ছোট দুর্নীতিগুলো তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন- বিভিন্ন কমিশন অথবা সংস্থা টানাহেঁচড়া করছে, যারা বড় ধরনের দুর্নীতি করছে, যেমন কুড়িগ্রামে যে ঘটনাটি ঘটল, সেটির পেছনের মূল শক্তিটি ছিল রাজনৈতিক শক্তি। একজন প্রতিমন্ত্রী ও তার যোগসাজোশে এসব হয়েছে। যে কারণে শিক্ষকসহ অন্যান্য যারা আছেন তারাও বাধ্য হয়েছেন সেখানে যেতে।
এখানে যারা দুর্নীতি অথবা অনিয়মের জন্য দায়ী, যাদের কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা যায় না। এর কারণ হচ্ছে এদেরই তো দুর্নীতি দমন করার কথা। কিন্তু এরাই মূল হোতা এবং এরাই দুর্নীতিকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে এবং আপাত অর্থে লাভবান হয়।
আমি বলব যে, নতুন বছরে আসলে নতুন কিছু নেই। যেটি পুরাতন সেটিরই সমাধান জরুরি। কারণ সমস্যাটি তো অনেক পুরোনো। নতুন বছরে আমরা যেটি করতে পারি সেটি হচ্ছে যে, চিত্রটির পরিবর্তন ঘটানো। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও তার নিজের অবস্থান থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থানে থাকবেন বলেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী একা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করেন না। কাজেই যাদের এই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ দায়িত্ব, প্রধানমন্ত্রীর কথার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের উচিত হবে, কারো প্রতি ভয় ও করুণা না করে, যারা দুর্নীতি করে, তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা দৃষ্টান্তমূলকভাবে। সেটি সম্ভব হলে আমরা মনে করি যে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কারণ আমি মনে করি, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ কোনো রকেট সাইন্স না যে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে আমাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু সেটিই বলে।
আমাদের ভাবতে হবে, দুর্নীতি কি একটি অপরাধ কি না? কোনো অপরাধই সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ হয় না যদি না যারা অপরাধী তারা বিচারহীনতা উপভোগ করে, তারা যদি সুরক্ষা পায়, তাহলে সেই অপরাধ বিস্তার লাভ করবে এটিই কিন্তু স্বাভাবিক। কাজেই দুর্নীতি রোধের মূল চাবিটি হচ্ছে যারা দুর্নীতি করে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। বিশেষ করে যারা সিন্ডিকেট করে, যারা ক্ষমতাবান, যারা রাজনীতির সঙ্গে, যারা প্রশাসনের সঙ্গে, সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের সব ভয় ও করুণার ঊর্ধ্বে থেকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এটি করতে পারলে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি দমনের যে ঘোষণা দিয়েছেন সেটি কার্যকর করা সম্ভব হবে।
সেক্ষেত্রে জনসচেতনা বৃদ্ধি করা একান্তভাবে দরকার। সুধী সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী ইত্যাদিসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। তারা দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করবে। যারা করছেন, ভালোভাবেই করছেন, আরও বেশি ভয় ও করুণার ঊর্ধ্বে থেকে কোনোপ্রকার পক্ষপাতিত্ব না করে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করবেন।
দুর্নীতি কোথায় হচ্ছে, কারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করার মাধ্যমে তারা যেন তথ্যউপাত্ত ও বিশ্লেষণ করে, সেইসঙ্গে অনুসন্ধানের একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। তাদের দক্ষ প্রযুক্তির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে এটি যেমন তাদের দায়িত্ব পালন হবে, একইসঙ্গে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আমাদের কাজ, আমরা দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত চিত্র তুলে ধরব। কিন্তু দুর্নীতি যারা দমন করার দায়িত্বে থাকবে তারা সেই তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেবে। যারা দুর্নীতি নিয়ে কাজ করে, গবেষণা করে, তথ্য তুলে ধরে, তাদের জন্য কাজের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
এসএন