নববর্ষের নতুন সুর্য সময়ের নতুন বাতিঘর
নতুন বছর শুরু হলো। আমার কাছে একটি দিন মানে একটি মাত্র উৎসব নয়। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে উচ্চারিত হয়েছে বহুমাত্রিক অর্থ। জীবনের গভীর অর্থ খোঁজার যে মৌল দর্শন একটি জাতির চিন্তা-চেতনায় বিরাজ করে সেই অর্থের সবটুকু ধারণ করে থাকে বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ নববর্ষ দিন।
বছরের প্রথম দিনে আমার আশা বাঙালি জাতীয়তাবাদের মৌল অনুপ্রেরণায়, অসাম্প্রদায়িক বাঙালির আকর আধার মনুষ্যত্ব বিকাশের শুভশক্তিও আত্মপরিচয় বৃদ্ধির মূলক্ষেত্র এবং বিশ্বজোড়া মেলবন্ধনে মানবিকতার মৌলিক শর্ত।
নব জাগরণের ঘণ্টা ধ্বনি বাজায় এই উৎসব। মানুষ জড়ো হয় আপন নিয়মে। শহরের ইট-কাঠ থেকে গ্রামের মেঠোপথ পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্য অর্থে বলা যায়, এই উৎসব এখন এর সবটুকু শহরের প্রতিটি মানুষের প্রাণের স্পন্দন। নন্দিত হয় পুরো দেশ।
মনীষী অন্নদাশঙ্কর রায় তার ‘সংস্কৃতির বিবর্তন’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, “আমরা ক্রমশ হৃদয়ঙ্গম করছি যে দেশকে স্বাধীন করাই যথেষ্ট নয়। দেশের মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে, সৃষ্টি করতে, নির্মাণ করতে শেখাতে হবে। পশ্চিমের সঙ্গে, আধুনিকের সঙ্গে পা মিলিয়ে নিতে হবে। পশ্চাতের সঙ্গে, ঐতিহ্যের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করতে হবে। জনগণের সঙ্গে সংস্কৃতির সঙ্গে যোগসূত্র অবিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। সার্থক সংস্কৃতির এই তিনটি ডাইমেনশন।’
নববর্ষে তিনটি মাত্রাকে বাঙালির মর্মমূলে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। বাঙালি বুঝতে পেরেছে এই গোড়াটুকু আছে বলেই কোনো অপশক্তি তাদেরকে উপড়ে ফেলতে পারেনি। পাকিস্তান আমলের পুরো সময় ধরে এই চেষ্টা করেছে পাকিস্তানি সরকার। এই শক্ত বাঁধনটুকু ছিল বলেই দন্ত-নখর বিস্তৃত করেও কিছুই করতে পারেনি তারা। বরং বাঙালি আত্মশক্তি সঞ্চয় করেছে আরও প্রবলভাবে। নববর্ষ মানুষকে সেই বার্তা দেয় অশুভ শক্তির বার্তায় মানুষ পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে আর একটি নববর্ষ উৎসব উদযাপন করে।
পথচলায় বছরঘুরে নববর্ষ সময়ের বাতিঘর। বিভ্রান্তির যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই বাঙালির। অমোঘ শক্তির দীপ্তি তার মাথার উপর ছায়া হয়ে আছে। নববর্ষ মানেই পুরানো মোড়ক খুলে নতুনকে আলিঙ্গন করা।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘এই মহামান্বিত জগতের অদ্যকার নববর্ষ দিন আমাদের জীবনের মধ্যে যে গৌরব বহন করিয়া আনিল, এই পৃথিবীতে বাস করিবার গৌরব, আলোকে বিচরণ করিবার গৌরব, এই আকাশতলে আসীন হইবার গৌরব, তাহা যদি পরিপূর্ণভাবে চিত্তের মধ্যে গ্রহণ করি তবে আর বিষাদ নাই, নৈরাশ্য নাই, ভয় নাই, মৃত্যু নাই।’
বাঙালি এই গৌরবের জায়গাটি তৈরি করেছে। মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দান করে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলা ভাষার স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করে উপমহাদেশের মানচিত্র বদলে দিয়েছে। তারপরও বলতে হবে দুটো গভীর ও ব্যাপক অর্জন বাঙালির সামনে পাহাড় সমান উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক. যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং দণ্ড প্রদান। দুই. হতদরিদ্র মানুষের জীবন থেকে দারিদ্র্যের অবসান ঘটিয়ে তাদেরকে মানসম্মত জীবনযাপনের ব্যবস্থা প্রদান।
নইলে রবীন্দ্রনাথ তার প্রবন্ধে নববর্ষকে মূলে রেখে যে আনন্দের কথা বলেছেন তা প্রকাশের যথার্থতা এই দেশে থাকবে না, যারা নববর্ষের উত্তরাধিকারী। রবীন্দ্রনাথ তার প্রবন্ধে একটি ঋষি বাক্য উল্লেখ করে বলেছেন ‘কেই বা শরীর চেষ্টা করিত, কেই বা প্রাণ ধারণ করিত যদি এই আকাশে আনন্দে না থাকিতেন। আকাশ পরিপূর্ণ করিয়া তিনি আনন্দিত, তাই আমার হৃৎপিন্ড স্পন্দিত, আমার রক্ত প্রবাহিত, আমার চেতনা তরঙ্গিত। তিনি আনন্দিত, তাই সূর্যলোকের বিরাট যজ্ঞহোমে অগ্নি-উৎস উৎসারিত; তিনি আনন্দিত, তাই পৃথিবীর সর্বাঙ্গ পরিবেষ্টন করিয়া তৃণদল সমীরণে কম্পিত হইতেছে; তিনি আনন্দিত, তাই গ্রহে নক্ষত্রে আলোকের অনন্ত উৎসব। আমার মধ্যে তিনি আনন্দিত, তাই আমি আছি-তাই আমি গ্রহ তারকার সহিত লোক লোকান্তরের সহিত অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত- তাহার আনন্দে আমি অমর, সমস্ত বিশ্বের সহিত আমার সমান মর্যাদা।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি অসাধারণ বাক্য সংযোজন করেছেন- ‘সমস্ত বিশ্বের সহিত আমার সমান মর্যাদা।’ বাঙালির সামনে আজ এই চ্যালেঞ্জ। নববর্ষকে সামনে রেখে বাঙালিকে এই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে এবং জয়লাভ করতে হবে ।
সেলিনা হোসেন: বাংলা একাডেমির সভাপতি ও কথাসাহিত্যিক