অকথ্য নির্যাতনের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন বীরাঙ্গনা নুরু বানু
নুরু বানু প্রথম থেকেই কথা বলার জন্য রাজি ছিল না। কয়েকবার তার বাড়িতে গিয়ে ফিরে এসেছি। তার মনে অনেক ক্ষোভ, অনেক কষ্ট, অনেক দুঃখ তিল তিল করে জমে আজ অনেক বড় একটা জায়গা জুড়ে বসবাস করছে। এটা স্পষ্ট বুঝা যায় তার কথাবার্তা থেকেই। দেখলেই মনে হয় সব সময় রেগে আছে। কোন একদিন আমরা বেড়াতে যাই চান্দিনা। দুই দিন ছিলাম। তখন একদিন তার বাড়িতে যাই। গিয়ে তাকে পেয়ে যাই বাড়িতে। আমরা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নুরু বানু তার ঘরে ডেকে নেন। এই বৃষ্টির সময় বসে বসে অনেক কথা হচ্ছে। তখন আস্তে আস্তে চলে যাই তার ক্ষতের জায়গায়, দুঃখের জায়গায়। প্রথমে তিনি অন্য প্রসঙ্গে অনেক কথা বলেন। কিন্তু আমি এমন একটা পরিবেশ তৈরি করি যার ফলে, তিনি নিজে থেকেই অনেক কথা বলেন।
আপা, আপনি আরও কয়েকবার আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলিনি। তাই হয়ত আপনি কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু সত্যি বলছি, আপনাকে আমি কষ্ট দিতে চাইনি। এটাও সত্যি যে, আপনার চেয়ে অনেক বেশি কষ্টের মধ্য দিয়ে আমাকে প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহুর্ত পার করতে হয়। যদিও এই জটিলতা এখন কিছুটা কমেছে। একদিন হয়ত সব জটিলতার শেষ হবে। কিন্তু কথা হ’ল, সেই দিনটা আমি দেখে যেতে পারবো কি-না।
যুদ্ধের আগে বেশ ভালই ছিলাম। গ্রামে আর ৮/১০ জন মেয়ে যেভাবে বড় হয়েছে, আমিও সেভাবেই বড় হয়েছি। ছেলেবেলার জীবন সবারই খুব সুন্দর ও মধুর হয়। আমারও এমন সুন্দও ও মধুর ছেলেবেলা ছিল। কিন্তু সেইসব ফেলে আসা দিনগুলো আর ফিরে আসেনি, আর আসবেও না কোনদিন। মা-বাবা, ভাইবোন মিলে এক সঙ্গে কত সুন্দর দিন পার করেছি।
এটুকু বলি ছোট করে, আমরা ছিলাম সাত ভাইবোন। তিন ভাই, চার বোন। বাবার ধনসম্পদ বলতে কিছুই ছিল না। দিন আনলে দিন খেতাম এমন অবস্থা ছিল। আমার খুব ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া করার। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। গ্রামের আরও অন্যান্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে স্কুলে গিয়েছি, কিন্তু প্রাইমারিও পাস করতে পারিনি। এর জন্য এক সময় আমার মনে খুব দুঃখ ছিল, এখন আর নেই। তখন তো ছোট ছিলাম, কোন কিছু বুঝতাম না। আমার বয়সী ছেলেমেয়েরা যখন আমার সামনে দিয়ে স্কুলে যেত তখন আমি দূর থেকে দেখতাম। তারপর মাঠে-গঞ্জে খেলতে চলে যেতাম, না হয় গরু-ছাগল চড়াতে নিয়ে যেতাম আর মায়ের সঙ্গে সঙ্গে সংসারের কাজকর্ম করতাম। যখন স্কুল ছুটি হবার সময় হতো, তখন যেদিক দিয়ে ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে, দৌড়ে গিয়ে সেই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে কথা বলতাম, এটা সেটা জিজ্ঞাসা করতাম। স্কুল সম্পর্কে, ক্লাস সম্পর্কে এমনকি স্যারদের কথাও জানতে চাইতাম। তারা সবাই মন থেকে আমার কথার উত্তর দিতে চাইত না। তার পরও আমি জিজ্ঞাসা করতে থাকি। একটা সময় এলো, আস্তে আস্তে স্কুলের সবকিছু থেকেই দূরে সরে যাই, আর পথ চেয়ে থাকি না, কারো কাছে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করি না। কিন্তু অনেক দিন মনে অনেক কষ্ট ছিল। থাক সেই সব কথা। যা চলে গিয়েছে তা তো আর ফিরিয়ে আনা যায় না, তা নিয়ে দুঃখ করা ঠিক না।
কিছুটা বড় হতে না হতেই বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয়। যদিও তখন মেয়েদের বিয়ের বয়স বলতে কোন কথা ছিল না। যদি বিয়ের বয়স নিয়ে কথাবার্তা হতো তাহলে লোকজন বলতেন, মেয়েদের বিয়ের বয়স হয় ১০ বছর থেকে। ১২/১৩ বছর হ’ল মেয়েদের বিয়ের সঠিক বয়স। আর তখনকার সময় মেয়েদের ইচ্ছা অনিচ্ছা বলে কোন কিছু ছিল না-কি। কত মেয়ে আছে বিয়ে কি জিনিস তার কিছুই জানতো না, বুঝতোও না। তার পরও বিয়ে দিয়ে দিতে হতো। আমার যখন বিয়ে হয়েছে তখন বুঝতাম না বিয়ের মানে কি। শুধু জানতাম বিয়ে দিতে হবে, বিয়ে হবে। বাবা-মা, বাড়ির লোকজন বলছে আমার বিয়ে। ব্যাস, আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
১৯৬৯ বা ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে কোন এক সময় আমার বিয়ে হয়। মোটকথা যুদ্ধের আগেই আমার বিয়ে হয়েছে। যুদ্ধের আগেই একটা ছেলে হয়েছিল। যখন যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তখন এলাকা থেকে দলে দলে মানুষ যুদ্ধে যাচ্ছে। আমার স্বামীর ইচ্ছে ছিল যুদ্ধে যাওয়ার। কিন্তু সে যদি যুদ্ধে চলে যায় তাহলে এত বড় পরিবার কিভাবে চলবে। তখন আমাদের সংসারে ছিল অনেক লোক। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, ননদ-দেবর সহ অনেক লোক। আমার স্বামী রিক্সা চালাতেন। শ্বশুর টুকটাক কাজ করতেন। কিন্তু আমার স্বামী ছিল মূল রোজগার করা মানুষ। যুদ্ধে যায়নি তাতে কি, মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কাজ করেছে।
আমার স্বামী সারা দিন রিক্সা চালাতেন আর রাতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গিয়ে বিভিন্ন খবর দিতেন। কখনও কখনও রিক্সায় করে মুক্তিবাহিনীর জন্য ভাত তরকারি নিয়ে যেতেন। এ খবর কিভাবে যেন রাজাকারদের কাছে চলে যায়। একদিন স্থানীয় কয়েকজন রাজাকার এসে আমার স্বামীকে এই বলে শ্বাসিয়ে যায় যে, তুমি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে যাও, খাবার দিয়ে আস, তাদের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে। এই খবর মিলিটারিদের কাছে চলে গিয়েছে। তারা তোমার সম্পর্কে সব জেনে গিয়েছে। তুমি জান ভবিষ্যতে তোমার পরিণতি কি হতে পারে? ভবিষ্যতে তোমার খুব খারাপ হবে। তখন আমরাও বাঁচাতে পারবো না। যদি বাঁচতে চাও তবে সাবধান হয়ে যাও। আশা করি, আর এ কাজ করবে না। এসব বলে তারা চলে যায়। ঠিক তার পরদিনই মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়িতে চাল ডাল তরকারি পাঠিয়ে দেয়। আমি তাদের জন্য ভাত-তরকারি রান্না করে রাখি। আমার স্বামী কাজ থেকে এসে সব খাবার রিক্সায় করে দিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দিয়ে বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে একদল পাঞ্জাবী এসে আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। আমার স্বামী ও শ্বশুরকে বেদম মারধর করে এবং বেশ কয়েকজন মিলে আমাকে নির্মম, নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করে।
সেই দিনের পর থেকে মিলিটারিরা প্রায়ই দল বেঁধে আসতো এবং আমাকে নির্যাতন করতো। দল বেঁধে যখন নির্যাতন করে তখন আর সহ্য করা যায় না, অনেক কষ্ট হতো। অনেক কষ্টে যদি আমি নড়াচড়া করতাম, এপাশ ওপাশ করতাম, তখনই আমার স্বামীর উপর অত্যাচার চালাতো। ঘরের ভেতরে আমাকে, আর ঘরের বাহিরে আমার স্বামীকে। মাঝে মাঝে শ্বশুররের উপরও অত্যাচার চালাতো। একবার পর পর কয়েকদিন অনেকগুলো মিলিটারি এসে আমাকে নির্যাতন করল। একদিন একদল মিলিটারি আসে আমাকে নির্যাতন করার জন্য। সেদিন আমার শরীর খুব বেশি খারাপ থাকায় আমি তাদেরকে অনেক অনুরোধ করি। কেন আমি অনুরোধ করেছি, তাই আমার স্বামীর উপর শুরু করে অত্যাচার। মারতে মারতে পঙ্গু করে ফেলেছে। মিলিটারিদের মারের চোটে প্রথম প্রথম কয়েকটা চিৎকার করেছিল। তারপর তো তার কোন হুঁশই ছিল না। মিলিটারিরা যখন বাহিরে আমার স্বামীকে মারছে, তখন আমি অন্য দরজা দিয়ে ঘর থেকে বাহির হয়ে পালিয়ে থাকি। এ সময় ঘরে এসে আমাকে না পেয়ে আমার শ্বশুকে মেরেছে। তারা ভেবেছিল, আমার স্বামী মারা গিয়েছে, তাই ফেলে রেখে চলে গিয়েছে।
সন্ধ্যা হলে আমি ফিরে আসি। এসে দেখি, আমার স্বামী পড়ে আছে। তার সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত। শরীর থেকে যে রক্ত বের হয়েছে, সেই রক্ত পোকা-মাকড় আর কুকুরে খাচ্ছে। তার সারা শরীরে বড় বড় পিঁপড়া হাটাহাটি করছে। এ অবস্থা দেখে ভয়ে আমি জোরে চিৎকার করি। আমার চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই ছুটে আসে। সবাই মনে করেছে, সে মারা গিয়েছে। কেউ তার কাছে যাচ্ছে না, ধরছে না। আমি তখন তার কাছে গিয়ে দেখি, সে বেঁচে আছে। তখন আমি আমার আঁচল দিয়ে তার সারা শরীর মুছে দেই। কবিরাজ এনে যা যা করার করি। তারপর আমরা আমার বাবার বাড়িতে চলে যাই। আমি বলি, এখানে যদি থাকি তবে মিলিটারিরা আসতেই থাকবে আর আমাকে নির্যাতন করতেই থাকবে। এক এক করে বাড়ির সবাইকে শেষ করে দিবে।
এক সময় দেশ স্বাধীন হ’ল। কিন্তু আমার স্বামী আর সুস্থ হচ্ছে না। দিন দিন স্বামী অসুস্থ হতে থাকে। তাকে নিয়ে চলাফেরা করার মতন অবস্থা নেই। টাকা পয়সা না থাকায় স্বামীর চিকিৎসাও করাতে পারিনি। তার ওপর নেই পেট ভরে খাওয়া-দাওয়া। আধ পেট খেয়ে, বিনা চিকিৎসায় আমার স্বামী শেষ হয়ে গিয়েছে। স্বামী না থাকলে স্বামীর বাড়িতে কি আর জায়গা হয়। যতটুকু জমিজমা ছিল, তা বিক্রি করে তো তার চিকিৎসাই করেছি। স্বামী মারা যাওয়ার পর মাথা গোঁজার ঠাঁই-ও চলে যায়। ফিরে আসি বাবার বাড়িতে। বাবা-মা নেই। ভাইদেরও সংসার আছে। তাদের সংসারেও অভাব অনটনের শেষ নেই, কাকে কে দেখে। তার পরও থাকার জন্য ভাঙ্গাচোরা একটা ঘর দিয়েছে, যে ঘরে বৃষ্টি হলে পানি পড়ে। ঘরের চাল ফুটা, বেড়া ভাঙ্গা। তার পরও বলবো, একটা আশ্রয় আছে। ছেলেকে নিয়ে থাকি।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও প্রাবন্ধিক
/এএস