বীর শহীদদের সমরকীর্তি অম্লান থাকবে বাঙালির মানসপটে
আজ থেকে ৫১ বছর আগে শুধু দুই বাংলার বাঙালিরাই নয়, ভারতের ৮৫ কোটি মানুষ এবং বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন কখন ঘড়িতে সাড়ে ৪টা বাজবে। আর অপেক্ষা নয়। ৯ মাস অপেক্ষা করা হয়েছে। যদিও প্রতাপশালী ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর সেনাবাহিনী এক এক করে পাকিস্তানের সেনা উর্দির ব্যাজগুলো খুলে টেবিলে রেখে দিলেন। পাকিস্তানের পক্ষে নেতৃত্ব দিলেন লে. জেনারেল নিয়াজি। ভারতের আত্মসমর্পণের দলিল গ্রহণ করলেন জেনারেল গোজি সিং আরোরা।
রেডিওতে এই খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...’। ঠিক একই সময় দিল্লির সংসদে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করতেই বাঙালি সদস্যরা দাঁড়িয়ে উঠে স্লোগান দিলেন, ‘জয় বাংলা’। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সদস্যদের আশ্বস্ত করে জানালেন, ‘আপনারা গত নয় মাস ধরে আমাকে যেভাবে সাহায্য করেছেন, আপনারা জানেন বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু এখন পাকিস্তানের জেলে। পাকিস্তানের উপর চাপ দেওয়ার জন্য আমি বিশ্ব নেতাদের কাছে আবেদন করছি। আপনারা এও জানেন যে, গত সেপ্টেম্বরে আমি ওয়াশিংটন গিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বলেছি, ‘আপনি পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির ব্যবস্থা করুন এবং বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধের ব্যবস্থা নিন। ওরা আমার কথা শোনেনি।’ কিন্তু ভারতীয় সেনারা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত করেছে। আজ আমরা গর্বিত।’
ঠিক এই সময় তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী শ্রীমতি গান্ধীকে বলেছিলেন, ‘আপনি মা দুর্গা’। তার কিছুক্ষণের মধ্যে বিবিসিসহ সব আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফুটে উঠল, বিশ্বে নতুন একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্মের খবর।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। এটিও একটি ইতিহাস। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তাজউদ্দীনের প্রথম ভাষণটি বারবার প্রচার করা হয়েছে ভারতের বেতার কেন্দ্র আকাশবাণী থেকে। তাজউদ্দীন সেদিন তার ভাষণে যা বলেছিলেন তা হলো, ‘সাড়ে ৭ কোটি মুক্তিপাগল মানুষের নেতা শেখ মুজিব ও তার মন্ত্রী সভার পক্ষ থেকে আপনাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা স্মরণ করছি তাদের, যারা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করেছেন। আকাশে যতদিন গ্রহ, তারা, নক্ষত্র থাকবে, মাটিতে মানুষ থাকবে, ততদিন বীর শহীদদের সমরকীর্তি অম্লান থাকবে বাঙালির মানসপটে। স্বাধীনতার পতাকাতলে আমরা আজ একাত্ম। যে প্রতিরোধ আপনারা গড়ে তুলেছেন, তা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
বিশ্বে আমাদের পরিচয় শান্তিপ্রিয়, মানবতাবাদী, নৃত্যগীত, শিল্প সংস্কৃতির পূজারীরূপে। হিংসা আমাদের চরিত্রবিরোধী। আজ প্রবল মরণাস্ত্র নিয়ে আমাদের উপর শত্রু ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আমরা তখন সেই মহান অবিচল থেকেও প্রমাণ করে দিয়েছি। বাঙালি দরকার হলে শক্ত হাতে অস্ত্র ধারণ করতে পারে।’
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কলকাতা শহরে বিজয় মিছিল হচ্ছিল, বিভিন্ন স্থানে পটকা বাজানো হচ্ছিল। ভারতীয় সময় বিকাল সাড়ে ৫টা নাগাদ দিল্লিতে লোকসভায় ইন্দিরা গান্ধী দ্রুতগতিতে প্রবেশ করতেই ৫৪৫ জন সদস্য উঠে দাঁড়িয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে হর্ষধ্বনি দিয়ে বরণ করে নেন। কলকাতা আনন্দবাজার পত্রিকার সামনে হাজার হাজার মুক্তিবাহিনী ও এ দেশের জনগণ জমায়েত হয়েছিল। তাদের মাইকের সামনে বলা হলো, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে জনগণ বিপুল উৎসাহে বলতে থাকে, ‘জয় বাংলা, জয় মুজিব, জয় ইন্দিরা গান্ধী, জয় যৌথ বাহিনী’। সংসদে বিরোধীদলের নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ী মন্তব্য করলেন, ‘আপনি মা দুর্গা’।
আর এস পি নেতা ত্রিদিব চৌধুরী এতই আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যে, তার মন্তব্যটি ছিল এরূপ- ‘সংসদে ৫৪৪ জন সদস্যই নারী। আপনি পুরুষ। আপনি যা পারলেন তা বিশ্ববাসী চিরদিন মনে রাখবে।’
লেখক: ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক
/এসজি