৭১-এর খোঁজে নদীযাত্রা
একটি স্বপ্নের কথা প্রথমে বলে নিই। আমাদের ভাই-বোনদের সেই স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আমাদের ভাই কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের উত্তর রণাঙ্গনে ১১ নম্বর সেক্টরে আমরা সব ভাই-বোন সেক্টর কমান্ডার তাহেরের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়েছি। সেই সময় একদিন তিনি আমাদের বললেন, যদি এই যুদ্ধে বেঁচে থাক তা হলে জীবনে অন্তত একবার স্বাধীন বাংলাদেশের উত্তর সীমান্ত দিয়ে যেসব নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, তার একটি ধরে নৌকায় যাত্রা শুরু করবে। নানা নদী বেয়ে যাত্রা শেষ করবে বঙ্গোপসাগরে। যাত্রাপথে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখবে অপরূপ সোনার বাংলার ছবি। কথা বলবে বাংলার সাধারণ মানুষের সঙ্গে। তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা। সাধারণ কৃষক মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের কথা শুনবে।
একই সঙ্গে সেইসব অসহায় নারী-পুরুষ, নিজেদের রক্ষা করবার জন্য যাদের হাতে অস্ত্র ছিল না, কিন্তু তারপরও যারা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, নিজেরা না খেয়ে তাদের খাবার দিয়েছে, শত্রুদের নিখুঁত অবস্থান বলে দিয়েছে, পরিণামে অকাতরে যাদের জীবন দিতে হয়েছে; কত মা-বোনেরা ধর্ষিত হয়েছে– সেই সব বিপন্ন মানুষজনদের বীরত্বগাঁথা, দুঃখ-বেদনার কথা শুনবে। গ্রাম-বাংলার দরিদ্র মানুষের নানা সমস্যা এবং তা সমাধানে তাদের ভাবনা জানতে চাইবে। তারপর কত বছর পেরিয়ে গেছে। নানা ঝড়-ঝঞ্জা বয়ে গেছে আমাদের জীবনে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, তাহেরসহ কত মুক্তিযোদ্ধা, অসহায় মানুষ যাদের কথা তাহের আমাদের বলতেন, তাদের আমরা হারিয়ে ফেলেছি অসময়ে। স্বপ্নপূরণ করতে পারিনি। কিন্তু স্বপ্নকে হারিয়েও যেতে দেইনি।
গত আগস্টে আমার বয়স ৭৩ পেরিয়ে গেছে। ভেবে দেখলাম আর দেরি নয়। লালমনি হাটের মোগলহাটে ভারত থেকে প্রবেশ করেছে ধরলা নদী। গত শীতের আগে সেখানে গিয়ে জানলাম রংপুরের বিপ্লবী কৃষক নেতা নুরলদিন; যিনি তার কৃষক গণবাহিনী নিয়ে ইংরেজ বাহিনী ও ব্রিটিশের তাবেদার জমিদারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করেছেন, তিনি ঘাঁটি গেড়েছিলেন এই মোগলহাটে। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের অমর সৃষ্টি ‘নুরলদিনের সারা জীবন’ কাব্যনাট্যের নায়ক নুরলদিনের উদাত্ত ডাক ‘জাগ, বাহে, কোনঠে সবায়’ বাংলার বিপন্ন কৃষক জনসাধারণকে আন্দোলিত করতে থাকবে অনাগতকাল ধরে। মুহূর্তে সেসব মনে পড়ল। তখনই স্থির করে ফেলেছি এই মোগলহাটের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধরলা নদী দিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হবে। একাত্তরে নদী ও নৌকা ছিল বিপন্ন মানুষের বেঁচে থাকার ভরসা। মুক্তিযোদ্ধাদের বাহনও ছিল নৌকা। অন্যদিকে নদী ও নৌকাকে ভয় পেয়েছে হানাদার বাহিনী। ৪ নভেম্বর, ২০২২ তারিখে একটি দেশি নৌকায় আমরা স্বপ্নযাত্রা শুরু করেছি।
ধরলা হয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যমুনা ধরে আমাদের নৌকা চলবে। এবারের মতো শেষ হবে বঙ্গবন্ধু সেতুর নিচে। যদি বেঁচে থাকি, আগামী বছর ২০২৩ সালের এমন সময়ে সেখান থেকে আবার যাত্রা শুরু হবে। নৌকা চলবে যমুনা ধরে, রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়ায় মিলিত হবে পদ্মায়। পদ্মা বেয়ে নৌকা এগোবে। চাঁদপুরে মিলিত হবে মেঘনা নদীতে। শেষ নদী মেঘনা হয়ে আমরা যাব হাতিয়ায় বিশাল বঙ্গোপসাগরের মোহনায়।
‘৭১-এর খোঁজে নদীযাত্রা ’ – এই শিরোনামটি প্রস্তাব করেছিলেন লালমনিরহাটের প্রথম আলোর প্রতিনিধি আবদুর রব সুজন। ৭১-এর জনযুদ্ধে গ্রাম বাংলার জনসাধারণ যারা সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ করেছেন, বিনিময়ে তেমন কিছুই পাননি, তাদের কথা শুনতে এই নদীযাত্রার কথাইতো বলেছিলেন কর্নেল আবু তাহের, বীর উত্তম। স্বাধীন বাংলায় যখন ফাঁসির মঞ্চে তিনি দাঁড়িয়েছেন, তখনো কারাগারের উঁচু দেয়াল অতিক্রম করে বিপ্লবী তাহেরের স্বপ্নময় দৃষ্টি বাংলার নদী, মাঠ ও বঞ্চিত-নিপীড়িত দরিদ্র জনসাধারণের উপর পড়েছিল, যাদের মুক্তির জন্য অকাতরে তিনি জীবন উৎসর্গ করলেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও তাই ৭১-এর খোঁজে নদীযাত্রা য় আমরা সামিল হয়েছি। চলতে চলতে আমরা থামব, কথা বলব সেই সব মানুষের সঙ্গে যাদের কথা অনেকেরই হয়তো বহুদিন শোনা হয়নি। আমরা তা আপনাদের জানাতে থাকব।
এবারের যাত্রায় আমার সঙ্গে সামিল হয়েছেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সহকারী পরিচালক মোগলহাটের কৃতিসন্তান মো. ফেরদৌস আলম। বলতে গেলে নদীযাত্রায় অংশ নিতে তার প্রবল উৎসাহ এবং বিপুল কর্মোদ্যোগে আমাদের বহুদিনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পাচ্ছে। আরও যুক্ত হয়েছেন নদীকে ভালোবাসেন, গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে গভীর নৈকট্য আছে এমন দুজন, রানা ঠাকুর ও জিয়াউদ্দিন রাজ্জাক অপু। চির বিপ্লবী সৈয়দ বাহারুল হাসান সবুজ আছেন আমাদের সঙ্গে। কুড়িগ্রামের শিমূলবাড়ির ওবায়দুল হক ও মাহাবুল হক আমাদের দেশি নৌকার মাঝি হিসেবে আমাদের সঙ্গে থাকবেন পুরো যাত্রায়।
পরের যাত্রা যদি কোনো কারণে সম্পন্ন করতে অপারগ হই, তাতে দুঃখ করব না। আমি জানি নতুন প্রজন্মের কেউ না কেউ তা সম্পন্ন করবে।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এসএন