জ্বালানি খাতে টেকসই উন্নয়ন জরুরি
বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট দ্বিমুখী। একদিকে জ্বালানি ভোক্তাদের সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের ভর্তুকি বেড়ে গেছে। সংকটটা চলে আসছিল আগে থেকেই। কয়েক মাস আগে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে যখন বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) গণশুনানির আহ্বান করল, আমরা সেখানে এর প্রতিবাদ করেছি। আমরা বলেছি, সংকট সমাধানে সরকার চাইলে সীমিত পর্যায়ে লোডশেডিং করতে পারে। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে চলতি বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৮ হাজার ৪১৬ কোটি ইউনিট নির্ধারিত হয়েছে। এর মধ্যে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ উৎপাদন কমালেও তরল জ্বালানি ব্যয়ের একটি বড় সাশ্রয় হবে। আমরা বলেছি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি হবে আত্মঘাতী।
জ্বালানি সংকট বর্তমান সময়ে অনেক বড় সংকট হিসেবে বিবেচিত। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে বেসরকারিকরণ। এটি বর্তমানে বেসরকারি খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। যে কারণে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা দিতে হচ্ছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে মানসম্মত জ্বালানি উন্নয়ন হচ্ছে না। যেন তেন নন প্রফেশনাল ব্যবসায়ীরা এখন এসব জায়গায় ঢুকে পড়েছেন। উন্নয়নের নামে লুণ্ঠন হচ্ছে। সুতরাং এইসব প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও এলএনজির মূল্যবৃদ্ধির কারণেই এ সংকট হয়েছে। কিন্তু আমরা মনে করি, সরকারের ভুল নীতির কারণেই এটি হয়েছে। সরকার ইচ্ছা করেই দেশের গ্যাসসম্পদ নতুন করে অনুসন্ধান ও আহরণের চেষ্টা করেনি। এক সময় বলা হতো দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। ২০১৬ সালের পর সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলতে শুরু করলেন, মাটির নিচে গ্যাস নেই। দুটোই অসত্য। এখনো আমাদের বিদ্যুতের ৬০ শতাংশের বেশি আসে দেশীয় উৎস থেকে। সরকার যদি বিচক্ষণতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে না। দুর্ভাগ্য হলো সরকার পুরো বিষয়টি দেখছে রাজস্ব ঘাটতির দৃষ্টিভঙ্গিতে। ভোক্তার স্বার্থের কথা তারা ভাবছে না।
জ্বালানি খাতে এখন যে উন্নয়ন হচ্ছে, সেটি অসম এবং সামঞ্জস্যহীন। কিন্তু আমরা বলেছি, টেকসই উন্নয়ন হতে হবে। টেকসই উন্নয়ন হলে ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়ই লাভবান হবে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছেমতো ব্যয় বাড়াল। আবার এসব প্রতিষ্ঠানকে বলে দেওয়া হলো এত ভাগ লাভ করতে হবে। ফলে সেই লাভ ধরে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়ানো হলো। ভোক্তা দুই দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
গ্যাস উত্তোলনের চেষ্টা না করার বিষয়টি মানুষের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু এর বাইরে কিছু অস্পষ্ট বিষয় আছে, যেগুলো সাধারণ মানুষ দেখছে না। সিঙ্গেল সাইকেলের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা কম, গ্যাস খরচ হয় বেশি, বিদ্যুৎ কম দেয় আর কম্বাইন্ড সাইকেলে গ্যাস কম খরচ হয়, বিদ্যুৎ বেশি দেয়। সিঙ্গেল সাইকেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসে ব্যয় হয় দেড় টাকা করে, আর কম্বাইন্ড সাইকেলে সেই খরচ ১ টাকা ১০ পয়সা। যে গ্যাস সিঙ্গেল সাইকেলে ব্যয় করা হচ্ছে, তা যদি কম্বাইন্ড সাইকেলে ব্যয় করা হত, তাহলে দেড় গুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হত। এখন পিডিবির যে কম্বাইন্ড সাইকেলের বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার খরচ অনেক কম, সেগুলোর সক্ষমতার মাত্র ৩৬ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। ভোলার বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে সবচেয়ে কম খরচ হয়, অথচ সেটির ক্ষমতা ব্যবহার হয় মাত্র ৩৮ শতাংশ। এখন সেটি যদি ৭৪-৭৫ শতাংশ করা যায়, তাহলে গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ২ টাকার নিচে নেমে আসে। ভোলার কম্বাইন্ড সাইকেলের সেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নাকি গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে। এভাবে নানা ধরনের সমীকরণ এখানে ঘটেছে।
কারণ, সরকার ব্যবসা করার মডেলে ঢুকে গেছে, যাতে মানুষেরই সর্বনাশ ঘটছে। এখানে সরকারের ব্যবসা করা, করপোরেট কালচার তৈরি করে কর্মকর্তাদের সুবিধা গ্রহণ আর কিছু মানুষের পকেট ভারী করা--এ তিন কারণেই মূলত বর্তমান জ্বালানি সংকট। কিন্তু সরকার তো ইউক্রেন যুদ্ধকে এর জন্য দায়ী করছে। অবশ্যই ইউক্রেন যুদ্ধ এখানে মুখ্য নয়। সেটির প্রভাবও অস্বীকার করা যাবে না। তারপরও আমাদের যে নিজস্ব জ্বালানি আছে, তা দিয়ে এখনো আমরা এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারি। জ্বালানি খাতের বিশৃঙ্খলার জন্য যে কারণগুলোর কথা আমি বললাম, সেগুলো না থাকলে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব আমরা এড়াতে সক্ষম হব।
লেখক: জ্বালানি উপদেষ্টা, ক্যাব