আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের কূটনীতি
আমাদের অন্যতম নিকটতম প্রতিবেশী হলো ভারত। একইভাবে চীনকে আমাদের কাছাকাছি প্রতিবেশী হিসেবে আমরা জানি। চীনের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। বাংলাদেশ হওয়ার আগে থেকে কিন্তু চীনের সঙ্গে মানুষের একটি দুর্বলতা ছিল। যদিও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সময়ে চীনের ভূমিকা নিয়ে আমাদের অনেক প্রশ্ন আছে।
পরবর্তীকালে চীন আমাদের অর্থনৈতিক বিকাশের সহযাত্রী হয়। নিরাপত্তা কাঠামো বলেন, বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজে চীন কিন্তু আমাদের সহযোগিতা করে। এখনো চীন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কটি সরাসরি নিরাপত্তা সংক্রান্ত না হলেও আমরা অর্থনৈতিক সম্পর্কটি যদি বিবেচনা করি, চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিভিন্ন দেশ থেকে যে আমরা পণ্য সামগ্রী আমদানি করি, তারমধ্যে চীনের অবস্থা কিন্তু প্রথম তারপর ভারত। কাজেই অর্থনৈতিকভাবেও আমরা কিন্তু চীনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এ ছাড়া, চীন যেহেতু বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতি, সেক্ষেত্রে আমরা মনে করি চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক শুধুমাত্র দ্বিপাক্ষিক না, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। কাজেই শুধুমাত্র দ্বিপাক্ষিক না, চীনের সঙ্গে সম্পর্কটি ত্রিপাক্ষিকমাত্রায় আছে। যেমন রোহিঙ্গা ইস্যু। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও চীনা চেষ্টা করছে ইতিবাচকভাবে সমাধানের জন্য। বাংলাদেশ মিয়ানমার এবং চীন যারা ত্রিপাক্ষিকভাবে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কাজ করতে চেষ্টা করছে। কাজেই চীনাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক শুধু দ্বিপাক্ষিক তা নয়। এর বাইরেও উপাদান আছে।
চীন যেহেতু বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, এশিয়া অঞ্চলের প্রধান হিসেবে পরিগণিত হয়েছে, কাজেই আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সঙ্গে সঙ্গে চীনকে আমরা এশিয়া বা দক্ষিণ অঞ্চলে ইতিবাচকভাবে কাছে পেতে চাই। কাজেই ভারত ও চীনের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক সেটিকে আমরা কখনো নেতিবাচক ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে চাই না। আমরা দুদেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চাই। আমরা দুদেশের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলছি। এটি আন্তর্জাতিকভাবে মোটামোটিভাবে আলোচিত হচ্ছে। আমি মনে করি এটি আমাদের জন্য একটি ইতিবাচকভাবে কূটনৈতিক জায়গা তৈরি হয়েছে।
গত কয়েক সপ্তাহে যেটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভূ-রাজনীতি কিন্তু প্রচণ্ড গতিতে এই অঞ্চলের ভেতর চাপ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পরে, এখন পাশ্চাত্য জগত শক্তিশালীভাবে ইউক্রেনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ন্যাটো সম্মেলনে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড দুটি দেশকেই নতুন সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেখানে কিন্তু তারা চীনকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা শুরু করেছে। এখানে চীনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশি হিসেবে যেমন জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সাউথ কোরিয়া তারাও কিন্তু প্রথমবার এই ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দিল। এটি আমার কাছে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা মনে হচ্ছে। এখন চীনকে কেন্দ্র করে আরেকটি ভূ-রাজনৈতিক বিবর্তন কিন্তু শুরু হচ্ছে। সেই জায়গায় ভারতের একটি অবস্থান আছে। যদিও ভারত ইউক্রেনের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছে।
উন্নত সাতটি দেশের সম্মেলন হয়ে গেল জার্মানিতে। সেখানে ভারত আমন্ত্রিত অতিথি ছিল। সেই জায়গায় চীন ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিন্তু নতুন রকম টানাপোড়েন তৈরি করতে পারে। সেই প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য উভয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চলা ঝুকিপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপট মনে রেখে আমরা যদি সবার সঙ্গে সুষম সম্পর্ক রাখতে চাই, এক পক্ষ অন্য পক্ষের সঙ্গে কাজ না করে, তাহলে আমার ধারণা আমরা যে রাস্তায় হাঁটছি, আমাদের কূটনীতির সেই জায়গাটিই সঠিক পথ। তবে সেই জায়গাটি ধরে রাখার জন্য আমাদের অভ্যন্তরীণ শক্তি অথবা কূটনৈতিক দক্ষতা এই দুটি কাজ একইসঙ্গে করে যেতে হবে। তা না হলে আমরা কিন্তু ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাব। এখন বৈশ্বিক পরিবেশটি আমাদের বেশ ঝুঁকির দিকেই যাচ্ছে এবং আমাদের যে জায়গাটিতে যথেষ্ট চেষ্টা থাকে এবং সেটি আরও সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের নিজেদেরও বিচার বিশ্লেষণ গবেষণা ও দক্ষ কূটনীতি পরিচালনার বিকল্প আছে বলে আমি মনে করি না।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত