মঞ্চ নাটকের পঞ্চাশ বছরের অভিযাত্রা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা ভাবার হয়তো অবকাশ আছে। সর্বকালের সেরা বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দাসত্ব শৃঙ্খল ছিন্ন করে আমাদের মুক্ত করেছিলেন পরাধীনতার অভিশাপ থেকে। বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করল। আমাদের মঞ্চ-নাটক নব দ্যোতনায় উজ্জীবিত হয়ে উঠল। আজকের পূর্বসূরী নাট্যকারদের সঙ্গে প্রতিভাবান নব প্রজন্মের নাট্যকারেরা যোগ দিয়েছিলেন। ছয়-সাতটি নাট্যদলের নাট্য প্রযোজনায় মহিলা সমিতি মঞ্চ এবং গাইড হাউস মঞ্চ প্লাবিত হয়েছিল। বিশেষ কোনো প্রযুক্তি ছাড়া, আমাদের নাট্যকারেরা বিনা পারিশ্রমিকে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। আব্দুল্লাহ-আল-মামুন, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীন, মান্নান হীরা এবং সর্বোপরি কবি সৈয়দ শামসুল হক নাট্য রচনার ক্ষেত্রে আমাদের দেশকে আলোকিত করেছিলেন। এ ছাড়া, বিশ্বের বহু বিখ্যাত নাটক আমরা অনুবাদে ও রূপান্তরে মঞ্চায়ণ করে আমাদের মঞ্চকে নানা সাজে শোভিত করেছিলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত আমরা এই ধারাকে ধরে রাখতে পেরেছিলাম।
বর্তমানে পুরোনো নাটকের দলগুলো আগের মত আর সক্রিয় নেই। এটা প্রকৃতির নিয়ম। পুরোনো নাট্যদল চলে যায় নতুনদের আগমন হয়। বর্তমানে নতুন প্রজন্মের নাট্যজনেরাও নাট্য ক্রিয়ায় যথেষ্ট ভাল করছে। তবে মঞ্চ নাটককে পেশাগত মর্যাদায় স্থাপিত করতে না পারলে নাটকের মান উন্নয়ন হবে না। আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দেশের বিভিন্ন জেলায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর উদ্যোগে নতুন মঞ্চ গড়ার কাজে নিয়োজিত আছে। মঞ্চ-নাটককে পেশাগত মর্যাদায় উন্নীত করার প্রয়াসও বর্তমান সরকারের আছে।
সবশেষে বলব, ঢাকায় এই যানজটের সময় এলাকা ভিত্তিক নাটকের মঞ্চ নির্মাণ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। নতুন প্রজন্মের নাট্যজনেরা বর্তমানে নাট্য প্রযোজনার ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছে। আমি আশা করি, করোনা মুক্ত আগামী বছরগুলো আমাদের মঞ্চ-নাটক আবার নতুন দ্যোতনায় ও সৃজনে উজ্জীবিত হয়ে উঠবে। ‘নবজাগরণ’ অভিধা শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে প্রযোজ্য শিল্প ও সাহিত্য সৃজন কখনো এক গতিতে চলে না। কখনো আসে স্থিতির কাল, তারপরে আসে বহমানতার সময়। এ যেন, জোয়ার-ভাটার খেলা। স্থিতি বা নিম্নগতির কালকে অবক্ষয় ভাবাটা যথার্থ নয়। পৃথিবী জুড়ে চলছে ভেসে উঠা আর ডুবে যাওয়ার খেলা। শিল্প ও সাহিত্য সৃজনেও এর ব্যত্যয় ঘটে না। রেনেসাঁ বা নবজাগরণ বিরতির পরে আবার ফিরে আসে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পরে আনন্দের উম্মাদনায় নব জাগরণ এসেছিল। সেটা আবারও ঘুরে আসবে বলে আমি দৃঢ় আশা ব্যক্ত করছি। স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি ও আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবাষির্কীর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখছি; ঠিক একইভাবে আমাদের মঞ্চ-নাটকেও নতুন ভাবনা ও প্রয়োগের ফল্গুধারা বইবে, এই আমার বিশ্বাস।
সবশেষে বলব, সমগ্র পৃথিবী বর্তমানে করোনা মহামারিতে আক্রান্ত। পৃথিবীর কোনো দেশেই স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত নেই। আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণের ও মৃত্যুর হার কমার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আবার নতুন প্রাণবন্যা শুরু হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমির নাটক মঞ্চায়ণের তিনটি মিলনায়তনই খুলে দেওয়া হয়েছে। অক্টোবর, ২০২১ থেকে পূর্ণদ্যোমে নাটকের মঞ্চায়ণ শুরু হয়েছে। এরমধ্যে আমার নির্দেশিত ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রযোজিত এবং বরেণ্য প্রয়াত কবি ও নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক অনূদিত শেক্সপীয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটকেরও আবার মঞ্চায়ণ শুরু হবে। আমি ও অপি করিম অভিনীত নাট্যম রেপার্টরী প্রযোজিত ‘ডিয়ার লায়ার’ নাটকের মঞ্চায়ণও আবার শুরু হবে। নতুন নাট্য দলসমূহের প্রযোজনাগুলোর মধ্যে থাকছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ,বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাব, তাকে কেন্দ্র করে স্বাধীন ও সার্বভৌম নব-জাগরণের মঞ্চায়ণ এবং পাশাপাশি থাকবে সর্বকালের ঘৃণ্য ও নারকীয় ১৫ আগষ্টের হত্যাযজ্ঞের চালচিত্র এবং সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর কণ্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার অনন্য নেতৃত্বে শোককে শক্তিতে পরিণত করার মঞ্চ-অভিযাত্রা। আশা করি, সব বৈরী শক্তিকে পদানত করে আমাদের মঞ্চ-নাটক নতুন প্রজন্মের কুশলী মঞ্চায়ণে ক্রমাগত এগিয়ে যাবে।
লেখক: অভিনেতা-নাট্য নির্দেশক, লেখক ও কবি, একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত