পর্ব-২
শিক্ষকের মর্যাদায় বঙ্গবন্ধু
স্বাধীন বাংলাদেশে পথপরিক্রমায় এখনো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে অনেকখানি বাকি রয়ে গেছ। যে দুঃখী মানুষের ভাবনা, তার মৌলিক চিন্তার অংশ-সেই জায়গাটি পূরণ করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধু জনগণের সেই নেতা, যিনি বারবার উল্লেখ করেছেন তাদের কথা। তিনি ১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর পাকিস্তান টেলিভিশন সার্ভিস ও রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচারিত ভাষণে বলেছিলে, ‘অর্থনীতির সর্বত্র মজুরি কাঠামো ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির গ্রাস থেকে নিম্ন বেতনভুক কর্মচারী ও অল্প উপার্জনশীল ব্যক্তিদের বাঁচাবার জন্য দ্রব্যমূল্যে স্থিতিশীলতা আনতে হবে।’ আজকের দিনে তাই বলতে চাই, বঙ্গবন্ধু আর একবার এসে দাঁড়ান আপনার বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের পাশে।
করাচি মিয়ানওয়ালী কারাগারে নারীদের সংরক্ষিত ওয়ার্ডে তাকে আটক করে রাখা হয়। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরের দিন ছিল ৪ ডিসেম্বর। সেইদিন ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে বঙ্গবন্ধুর বিচারকারী ট্রাইব্যুনাল সদস্যদের ডেকে পাঠান। তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির রায় লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু পরে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই রায় স্থগিত করা হয়। এর মধ্যে তাকে ভয় দেখানোর জন্য তার সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল। তিনি তার দশ জানুয়ারির ভাষণে বলেছিলেন, ‘আপনারা জানেন যে, আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, আমার সেলের পাশে আমার জন্যে কবরও খোঁড়া হয়েছিল। আমি মুসলমান। আমি জানি, মুসলমান মাত্র একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের নিকট নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয়বাংলা।’
বঙ্গবন্ধু তার অধিকাংশ ভাষণে নিজের জাতিসত্তা, নিজের দেশ, নিজের মাতৃভাষার বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনিই সেই মানুষ, যিনি জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছিলেন নিজের মাতৃভাষায়। বাংলা ভাষাকে একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার আগে সংবিধানে বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ১৯৭১ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিষ্টিটিউটে তাকে প্রদত্ত একটা সংবর্ধনা সভায় তিনি বলেন, ‘সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুখ-শান্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাক্সক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য ও সংস্কৃতি।’ একটি জাতির জন্য তিনিই সেই নেতা যিনি বুঝেছিলেন যে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা কতটা জরুরি। এটাতো সত্যিই যে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা একটি জাতিকে মননে চেতনায় শাণিত করে। যে জাতি নিজস্ব সাংস্কৃতিক বোধে দীপ্ত নয়, সে জাতি শিকড়হীন পরগাছা মাত্র। বাংলাদেশের অনেক অর্জনে নিজেদের সাংস্কৃতিক বোধকে সমুন্নত রাখতে পেরেছিল বলেই বাঙালি তার আত্মমর্যাদায় দরিদ্র নয়। প্রতিটি সংকটে-সংগ্রামে সাংস্কৃতিক বোধ দিয়ে এ জাতি তার সংকটের উত্তরণ ঘটিয়েছে।
আবার ফিরে আসি বঙ্গবন্ধুর দশই জানুয়ারির ভাষণে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে শ্রদ্ধা করি...। আমি যখনই চাইব, ভারত বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্য বাহিনী তখনই ফিরিয়ে নিবে।’ আমরা জানি কোনো দেশ থেকে সাহয্যকারী সেনাবাহিনী সরিয়ে নেওয়া কত কঠিন। বঙ্গবন্ধুর মত অসাধারণ ব্যক্তি সেদিন আমাদের সামনে ছিলেন বলেই বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সেনাবাহিনী ’৭২ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ থেকে চলে গিয়েছিল। নিজেদের সার্বভৌমত্বের দিকে তাকিয়ে এ কথা বলতেই হয় যে, বঙ্গবন্ধুর এই নানামুখী চিন্তা এই দেশ ও জাতিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিল মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে।
সে দিনের ভাষণে তিনি আর একটি প্রসঙ্গের কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘যারা অন্যায়ভাবে আমাদের মানুষদের মেরেছে তাদের অবশ্যই বিচার হবে। বাংলাদেশে এমন পরিবার খুব কমই আছে, যে পরিবারের লোক মারা যায়নি। আজকে দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হচ্ছে। আমাদের গভীর বিশ্বাস এ বছর বিচারকাজ সম্পন্ন হবে এবং রায়ও কার্যকর হবে। যতদিন একটি দেশে অপরাধ টিকে থাকে ততদিন সে দেশের মানুষের মাথা অবনত থাকে। মানুষ চায় ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে নিজের মাথাকে সোজা করে রাখতে। আমাদের বিপুল অর্জন আছে। ব্যর্থতার জায়গাও কম নয়। তারপরও নিজেদের জন্য নিজেদেরকে বড় করে তোলার পক্ষে চেষ্টা নিরন্তর। আমরা এই নিরন্তর সাধনা থেকে বিচ্যুত হব না। এই প্রতিজ্ঞা আমাদের আগামী প্রজন্মের। এ প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগোতে চাইলে পিছু হটে যাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। মৌলবাদের উত্থান রহিত হলে যুদ্ধাপরাধী দেশ থেকে নির্মূল হবে।’ সেদিনের ভাষণে তিনি এ প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে নির্বিচার গণহত্যা করেছে, তার অনুসন্ধান ও ব্যাপকতা নির্ধারণের জন্য আমি জাতিসংঘের নিকট একটা আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠনের আবেদন জানাচ্ছি। আমরা মনে করি যুদ্ধাপরাধীর দায় বহন করার মত গ্লানি থেকে মুক্ত হবে এই জাতি।’
বঙ্গবন্ধু ১০ই জানুয়ারির ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে, আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ। এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, হিন্দু, মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’ প্রতিটি ব্যক্তির জীবনে এটি একটি বড় শিক্ষা। চেতনা সমৃদ্ধ করার দিকদর্শন। প্রত্যেক ব্যক্তি যদি এমন ভাবনায় আলোকিত থাকেন তবে দেশে দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না। মৌলবাদের উত্থান ঘটবে না। ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার দিন নিঃশেষ হবে। মানুষ নিজ নিজ ধর্ম পালনের পাশাপাশি অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করবে। সব ধর্মের অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে প্রত্যেক ধর্মের মৌলিক সত্যকে নিজেরা বুঝবে। আমাদের সামনে এক অসাধারণ শিক্ষার বার্তা। আমি এই বার্তা ধারণ করে শিক্ষক বঙ্গবন্ধুর কাছে কৃতজ্ঞ থাকি।
বইপড়ার বিষয়টি বঙ্গবন্ধু যেভাবে দেখেছেন এটিও আমার জন্য শিক্ষার একটি দিক। সাধারণ মানুষ যদি কাজের অবসরে বই পড়েন তাহলে সামাজিক মূল্যবোধের একটি বড় জায়গা তৈরি হবে। পরিবারে বইপড়ার চর্চা থাকলে শিশুদের মাঝেও আগ্রহ তৈরি হবে। পড়ালেখার পাশাপাশি শিশুদের হাতে ওদের পছন্দের বই পড়তে দিলে ওদের মানসিক বিকাশ বড় পরিসরে গড়ে উঠবে। ও চাকরি, ব্যবসা ইত্যাদি যেভাবেই জীবন ধারণ করুক না কেন মানসিক বিকাশ গড়ে উঠবে ভিন্ন মাত্রায়। এর দ্বারা আমাদের সামাজিক অবক্ষয় রোধ হবে। মূল্যবোধের অভাব আমাদেরকে নিকৃষ্ট ধারণায় ফেলে দেবে না। বই পড়ার চিন্তা রেখে শিশুরা গড়ে উঠুক। আমরা সুন্দর সামাজিকতায় দিনযাপনের সুযোগ পাব। নারী ও শিশুদের প্রতি নানা ধরণের নির্যাতন আমাদের মর্মাহত করবে না। বঙ্গবন্ধুর এই শিক্ষা সামগ্রিকভাবে সমাজ বিনির্মানের বড় দিক।
বঙ্গবন্ধু নিজে লেখক ছিলেন। তিনটি বই রচনা করেছেন। এই তিনটি বইয়ে বঙ্গবন্ধুর লেখক সত্তার অসাধারণ পরিচয় পাওয়া যায়। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে লিখেছেন: ‘বন্ধু শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ বইটি পড়তে শুরু করেছি। লাগছে ভালই, বাইরে পড়তে সময় পাই নাই।...রুমে বসে লেখাপড়া করা ছাড়া উপায় কি! তাই পড়লাম বইটা...।’ তিনি আর এক জায়গায় লিখছেন : ‘আজ আর খবরের কাগজ আসবে না। মিলাদুন্নবীর জন্য বন্ধ। দিন কাটানো খুবই কষ্টকর হবে। আমি তো একাকী আছি, বই আর কাগজই আমার বন্ধু। এর মধ্যেই আমি নিজকে ডুবাইয়া রাখি। পুরানা কয়েকটা ইত্তেফাক কাগজ বের করে পড়তে শুরু করলাম।’ এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুর পড়া বিদেশি বইয়েরও উল্লেখ আছে। তিনি এমন বইপ্রিয় মানুষ ছিলেন। এখানেও তাকে আমি শিক্ষক হিসেবে পাই। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চেতনায় তিনি একজন প্রদীপ্ত মানুষ। তিনি আমাদের সামনে নেই, কিন্তু জীবন পরিচর্যা করার দিকদর্শন রেখে গেছেন। আমাদের দায়িত্ব স্বাধীন দেশের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে আমার যা করতে পারিনি, এই নৈরাজ্য যেন আমরা বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারি। আগামী পঞ্চাশ বছরে গড়ে উঠুক স্বাধীনতার স্থপতির স্বপ্নের বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর সব কথার মধ্যে শিক্ষার অন্তর্নিহিত বাণী গেঁথে আছে। শুধু রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নয় ব্যক্তি মানুষের জন্যও এই কথাগুলো শিক্ষার বড় দিক। শিল্প-সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে মানুষের প্রতি অনুভবের মাত্রা বাড়ানোর এটি একটি দিক। এ জন্য বঙ্গবন্ধুকে আমি জীবন-শিক্ষক মনে করি। বাংলা ভাষার একজন লেখক হিসেবে শিক্ষক বঙ্গবন্ধুকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণে রাখি। তিনি আমার সামনে গৌরব অর্জনের নীতি নির্ধারক। শিক্ষকতার মানদন্ডে তার বিপুল পরিসর চেতনায় রাখি।
লেখক: সভাপতি, বাংলা একাডেমি ও কথাসাহিত্যিক