সময়োচিত বাজেটে ও মুদ্রানীতিই পথ দেখাবে আগামী অর্থবছরে
সারাবিশ্ব যখন দুই বছরব্যাপী করোনা সংকট থেকে বের হয়ে এসে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনই শুরু হয়ে গেল রুশ-ইউক্রেন অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ। বৈশ্বিক এই সংকটের কারণে আমাদের মতো দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা বেশ কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি আমদানি ও রপ্তানির সার্বিক মূল্যে ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতির হাত ধরে চলতি হিসেবেও ঘাটতি বেড়ে চলছে। খুব স্বাভাবকি নিয়মেই দেশীয় মুদ্রার মানের ওপর চাপ পড়তে শুরু করছে। চাপ সামলাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিচ্ছে। তবে তারও তো একটা সীমা রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে আসন্ন বাজেটের মাধ্যমইে সব অংশীজনকে স্থিতিশিীলতা রক্ষা করার পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দেশনা দিতে হবে । র্অথনীতিতে ডলারের প্রবাহ বাড়ানো এবং অপচয় রোধে সরকার ইতোমধ্যে কিছুটা সংকোচনমুখী নীতি গ্রহণের আভাস দিয়েছে। তবে এই সংকোচনের ধারার মধ্যেও টেকসই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে মাথায় রেখে আসন্ন বছরের আর্থিক পরকিল্পনা সাজাতে হবে।
বাজেটের কাটছাঁট যেন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজকি সুরক্ষার মতো খাতগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে তা নশ্চিতি করতে হব। স্বাস্থ্যখাতে গতানুগতিকভাবে বাজেটের ৫ শতাংশ বরাদ্দ না দিয়ে এই অনুপাত আসন্ন অর্থবছরে অন্তত ৮ শতাংশ করতে হবে। এর পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় বিশেষত চর্তুথ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে যথাযথ মানবসম্পদ উন্নয়ন খুবই জরুরি। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আসছে অর্থবছরের বাজেটেরে ২০ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করতে হবে (চলতি বছরে রয়েছে ১৬ শতাংশ)। বিদ্যমান অবস্থায় কম আয়ের পরিবারগুলো বেশি চাপে পড়ছে। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তাখাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে নতুন নতুন সুরক্ষা র্কমসূচি নিতে হবে। চলতি বছরে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া মাথায় রেখেই সামাজকি নিরাপত্তা বাবদ বাজেটের ১৮ শতাংশ রাখা হয়েছে। আসন্ন র্অথবছরেও এই ধারাবাহকিতা বজায় রাখা চাই এবং সম্ভব হলে ২০ শতাংশে উন্নীত করা চাই।
ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে কৃষি ও শিল্প-এই দুপায়ে এগিয়ে যাওয়ার যে নীতি বাংলাদেশে গত এক যুগের বেশি সময় ধরে অনুসরণ করছে এবং সাফল্য দেখছে-এবং সেই ধারাবাহকিতাও বজায় রাখা চাই। প্রথমেই আসে কৃষি খাত।
র্বতমান সরকার ধারাবাহিকভাবে কৃষিখাতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে তা খুবই র্কাযকর ও সময়োচিত বিনিয়োগ। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষক যেন চাপে না পড়ে, সেজন্য আসছে র্অথবছরে এ খাতে ভর্তুকি তিন গুণ করে ৩০ হাজার কোটি টাকা করা দরকার। অন্যদিকে ‘মেড ইন বাংলাদেশে’ অভিযানকে আরও গতি দিতে দেশি শিল্পায়নে দেওয়া বাজটের সুবধিাগুলো আরও কিছু বছর চালু রাখতে হব। আমদানি কৃত শিল্পায়নে কর ছাড়ে কার্পণ্য ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে যে, আমাদরে প্রবৃদ্ধরি ৬০ শতাংশেরও বেশি আসে অভ্যন্তরীণ ভোগ থেকে। আর তা মোটেও এসব শিল্প। বাড়ন্ত মধ্য ও উচ্চ আয়ের ভোক্তাদরে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের জোগানদাতা এসব শিল্পকে বাজেটে সমর্থন দিয়ে যেতেইে হবে।
বিগত বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরইে লিখে এবং বলে আসছি যে ২০২২-২৩ র্অথবছরের বাজেটে কী হতে হবে ‘আয় বুঝে ব্যয়’ করার বাজেট। সে বিবেচনায় এতোক্ষণ ব্যয় পরকিল্পনা নিয়ে যে পরার্মশগুলো এলো সেগুলো বাস্তবায়্নের মতো যথাযথ আয় যেন সরকারকে হয় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে আসন্ন বাজেটেই। আসন্ন অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে এটি জিডিপির ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি বছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রায় জিডিপির ১১ শতাংশের কিছু বেশি। র্অথাৎ জিডিপিরি শতাংশ হিসাবে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা আসলে কমতে পারে। এমনতিওে বাংলাদেশের মতো একটি অর্থনীতির দেশের জন্য কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের আশপাশে হওয়াটি কাম্য নয়। এই অনুপাত বাংলাদেশের জন্য ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হওয়া চাই। এ জন্য এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে আলাদা নজর দেওয়া দরকার।
জাতীয় বাজেটে দেশের অর্থনীতি কী এর পাশাপাশি মনিটরিং পলিসি তথা মুদ্রানীতি যদি তার সম্পূরক ভূমিকাটি পালন করতে পারে তবেই আসছে বছরে উল্লিখিত বড় চ্যালেঞ্জে মোকাবলিা করেও বাংলাদেশের অর্থনীতির নতুন প্রাণসঞ্চার ঘটতে পারে।
আগেই বলছে টাকার অবমূল্যায়নের চাপ ঠেকাতে যে কৌশল কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতদিন অনুসরণ করছে কিছুকাল কাজে দিয়েছি। কিন্তু এরও একটি সীমা আছ।গোটা বিশ্বরে অ্ধিকাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকই ডলারের বিপরীতে নিজস্ব মুদ্রার কমবেশি অবমূল্যায়ন করছে। এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি আমাদের কন্দ্রেীয় ব্যাংকের তরফ থেকে বৈদেশিক মুদ্রার বৈদেশিক নিয়মিতভাবে প্রয়োজনবোধে ভ্যালু্য়েশন করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেটিকে স্বাগত জানাতেই হবে। পাশাপাশি আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়েও ভাবা চাই। যে কোনো মূ্ল্যেই ডলারের যথেচ্ছা ব্যবহার বা উল্টাপাল্টা ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সব ধরনের বিলাসী পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণের সময় এসেছে। আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে করণীয় আছে।
অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমদানি শিল্পের প্রসারকে উৎসাহতি করার এখনও প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে দ্রুত বদলে যাওয়া বিশ্ববাণিজ্যের এই সংকটকালে কথাটি আরও বেশি প্রযোজ্য। এজন্যে এনবআির আর বাংলাদেশে ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে বিলাসী পণ্যের মার্জিন আরও বাড়িয়ে দিতে হবে। দরকারবোধে এটাকে ৮০ থেকে ১০০ পারসেন্ট র্পযন্ত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। এখনও টাকার ফ্রি ফল (অবাধে পতন) হচ্ছনা। তবে তা যাতে না হয় সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে।
স্বদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং এশীয় ও বৈশ্বিক সংকটে বাংলাদেশের উতরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে চলমান সংকটকে সম্ভাবনায় রূপান্তর খুবই সম্ভব বলে মনে হয়। কারণ সংকটকালেও স্বদেশি অর্থনীতি পরিচালনার বিরল অভিজ্ঞতার অধিকারি আমরা। তবে এ জন্য সময়োচিত বাজেটেও মুদ্রানীতি গ্রহণ এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। র্সবোচ্চ নীতিনির্ধারণী র্পযায় থেকে সে র্বাতাটইি আসছে । এখন সময় সকল অংশীজন সমন্বতিভাবে সেই নির্দেশনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর