পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন নিশ্চয়ই সাফল্য, তবে মিরাকল নয়
নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্প করা যে সম্ভব পদ্মাসেতু তারই বহিঃপ্রকাশ। এ বিষয়ে আমি বহুদিন থেকেই বলে আসছি যে, বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প করা সম্ভব। বিদেশি ঋণ নেওয়ার দরকার কি? প্রয়োজনীয় প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে করলে খরচ কম পড়ে এবং স্বাধীনভাবে করা যায়। যদি না সেখানে সরকারের দুর্নীতি অথবা অন্যকোনো ধরনের সমস্যা থাকে। তাহলে অনেক কম খরচে করা সম্ভব। বিদেশি ঋণ নিলে শর্ত মানতে হয়। অনেক বেশি খরচ হয়, তাদের কনসালটেন্ট তাদের সুবিধামতো বিভিন্ন কোম্পানি নিতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাংলাদেশে যে সকল প্রকল্প বিদেশি বিনিয়োগে হয়, তার অধিকাংশই অপচয় এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। সে হিসেবে এটি আমার কাছে নতুন অথবা বিষ্ময়কর ঘটনা নয়। বাংলাদেশ নিজেদের অর্থায়নে একটি মেগা প্রকল্প করতে পেরেছে সেটি খুশির কথা নিশ্চয়ই। তবে এটি মিরাকল কিছু নয়। আমাদের বলা এবং সরকারের কাজ করার মধ্যে একটি নীতিগত পার্থক্য আছে। আমরা মনে করি, এটি সরকারের পক্ষে করা সম্ভব। আর সরকার করেছে বাধ্য হয়ে। বিভিন্ন কারণে বিশ্বব্যাংক সরে গেছে বলে সরকার এটি করেছে।
বাংলাদেশে অনেক প্রকল্প যেমন রামপাল বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন প্রকল্প বিদেশি ঋণে করা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর বিষয়ে আমি বলব, এটি কতটা লাভজনক হবে, সেটি নির্ভর করে বিশ্লেষণের উপরে। এটির জন্য খরচ কত হলো—যেমন খরচের একটি দিক আর্থিক খরচ, দ্বিতীয়ত এর জন্য পরিবেশগত অথবা সামাজিক ক্ষেত্রে তেমন কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না। লাভ ও ক্ষতি এই দুটির তুলনামূলক বিশ্লেষণে যেটিকে বলে ‘কস্ট বেনিফিট এনালিসিস’ সেটি করার মাধ্যমে বোঝা যায় এটি কতটা লাভজনক অথবা লাভজনক নয়।
জিডিপি বৃদ্ধি অথবা লাভের যে হিসাবটি করা হয়েছিল, এটি যখন দশ হাজার কোটি টাকা ধরে করা হয়েছিল, সে হিসেবে মনে হয়েছে এটি অনেক বেশি লাভজনক হবে। কিন্তু ব্যয় তো অনেক বেশি হয়েছে। সেক্ষেত্রে এটি কতটা লাভজনক হবে সেটি নিয়ে একটি বিশ্লেষণ দরকার। এখন আমরা দেখি যমুনা সেতুর নিচে চর পড়ে গেছে। পদ্মার যদি এই দশা হয়, সেটিতো অনেক বড় ক্ষতি। এটি অপূরণীয় ক্ষতি হবে। সেগুলো হবে কি না, হলে সেটি কিভাবে সামাল দেওয়া যাবে, নদী শাসন বলে একটি বিষয় আছে, বিশেষ করে পদ্মা নদীর ক্ষেত্রে কিভাবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা যায় এগুলো দেখা দরকার।
নদীর ক্ষতি হওয়া মানে তার সঙ্গে সেই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার বিষয়টি জড়িত থাকে। পদ্মাসেতু হওয়ার আগে এখানে পণ্য পরিবহনের যে ব্যবস্থাটি ছিল, মানুষের চলাচলের যে ব্যবস্থাটি ছিল, সেটিতে অনেক অব্যবস্থাপনা ছিল। নৌযানগুলো ছিল দুর্বল। সেক্ষেত্রে মানুষের ভোগান্তি হয়েছে অনেক বেশি। যারা গাড়িতে আসতো, বাসে আসতো, অথবা এমনিতেই চলাফেরা করত, তাদের ভোগান্তি হতো অনেক বেশি। মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। এখন পদ্মাসেতু হওয়ার পরে এপার থেকে ওপার যাওয়া সহজ হয়ে যাবে। ঢাকায় ঢোকার ক্ষেত্রে যানজট বাড়বে কি না সেটি একটি বিষয়, তবে পদ্মানদী পার হওয়া সহজ হয়ে যাবে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার, আগের যে অবস্থাটি ছিল, সেই অবস্থাটির কি উন্নয়ন করা যেত না? আমি মনে করি, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা হচ্ছে নৌ যোগাযোগ। কাজেই নৌপথকে কি আরও শক্তিশালি করা যেত না? এখানে ৪/৫টা ফেরির জায়গায় কি ৩০/৪০টি অত্যাধুনিক শক্তিশালি ফেরির ব্যবস্থা করা যেত না? যেটি করা গেলে কোনো ধরনের যানজট থাকত না। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মানুষ, গাড়ি, ফেরি পারাপার করা সহজ হত। তুলনামূলকভাবে এটি তেমন কোনো খরচ না। অথচ খরচ ১০ হাজার কোটি টাকা থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত হয়েছে। কাজেই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নদী বাজার ব্যবস্থাপনার উপরই গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। নদীগুলোর উপর সড়ক, সেতু ইত্যাদি এমনভাবে বেড়েছে, ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের জন্য সুবিধাজনক হলেও আমাদের নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপদগ্রস্ত। নদীগুলো বিপদগ্রস্ত। নদীগুলোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের যে পরিবেশগত অবস্থা সেটিও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত এবং এগুলো দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। পদ্মাসেতুর ক্ষেত্রে এটির প্রভাব কিভাবে পড়বে, সেটি আমি মনে করি, উচ্ছ্বাস কমে গেলে এটির অনুসন্ধান ও গবেষণা হওয়া উচিত।
লেখক: শিক্ষাবিদ
আরএ/