এমন মহিরুহ যুগে যুগে জন্মায় না
আবদুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর। কী ব্যক্তিগত, কী পারিবারিক। গত শতকের ৫০ এর দশক থেকে সেই সম্পর্ক। আমার বয়স তখন কম। আমার সৌভাগ্য আমার শৈশব থেকে আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো বড় মাপের মানুষটির সান্নিধ্য পেয়েছি। তার স্নেহ পেয়েছি, উপদেশ, পরামর্শ, দিক নির্দেশনা পেয়েছি আমি এবং আমার পরিবারের সদস্যরাও। এত বড় মাপের একটি মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা মনে এলে ভাবি, তিনি তো গোটা দেশের মানুষের কাছেই ঘনিষ্ঠতর। হবেন না-ই বা কেন, তিনি তো একজন অসাম্প্রদায়িক ও পরিপূর্ণ মানবিক মানুষ হিসেবেই সবার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত।
কৈশোর থেকেই তিনি জড়িয়ে যান দেশের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে তার অমর কবিতা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে চিরকাল। কিন্তু তিনি কি শুধুই ভাষাসংগ্রামী ছিলেন? তার সৃষ্টির মাত্রা ছিল বহুমাত্রিক। তার অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-ভাবনা, মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকাসহ বাঙালি জাতির মুক্তির সমস্ত সংগ্রামে তার ভূমিকা অনন্য এবং তিনি ইতিহাসের অংশ হিসেবে প্রথম সারিতেই অবস্থান করে আছেন। কবিতায় তিনি কালজয়ী হয়েছেন, তার কথাশিল্পে পারদর্শীতার কথা কি বাদ দেওয়ার সুযোগ আছে? তার অনেক গুণই আজও অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে। তিনি ছিলেন সাহসী, বন্ধুবৎসল, স্নেহপ্রবণ ও আপোসহীন একজন মানুষ। তিনি তার বন্ধুত্বটাকে সর্বদা সবার সামনেই স্বীকার করেছেন। যারা নীতিগতভাবে তার বিরোধী, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষ, তাদের সঙ্গেও তার সর্বদা আন্তরিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক বজায় ছিল। ব্যক্তিগত সম্পর্ককে তিনি ব্যক্তিগত জায়গায়ই রেখেছেন এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি কোনোরকম আপোস করেননি। এটি ছিল তার চরিত্রের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। সবচেয়ে বড় কথা তিনি নিজের চিন্তা-চেতনা ও বিবেককে স্বার্থের কারণে কখনও বিক্রি করে দেননি। সারাজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন এবং উজাড় করে দিয়েছেন পুরোটাই। আবার তিনি ছিলেন একজন স্নেহময় পিতা, একজন দায়িত্বশীল স্বামী; সর্বোপরি তিনি একজন মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন পরিপূর্ণ মানুষ।
তিনি যখন ‘আওয়াজ’ বের করেন, তখন ছয় দফার কাল। ছয় দফাকে মানুষের কাছে নেওয়ার ক্ষেত্রে তার যে ভূমিকা— সে কথা কি ভুলে থাকা সম্ভব? বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতা লাভের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল তার সেসব আপোসহীন চিন্তা-দর্শন ও জীবন। পাকিস্তানের গোড়ার দিক থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা পরবর্তীকালে আমাদের দেশের অসাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় তিনি ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ব্যাপারে তার অবস্থান ছিল সর্বদা কঠোর।
একজন লেখক, একজন সাংবাদিক এবং একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে তার বড় একটি শক্তির দিক ছিল, তা হলো অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। প্রতিটি ঘটনাকে তিনি তার অতীতের অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে দারুণভাবে সাজিয়ে তুলতেন; যা পাঠককে দ্রুত কাছে টানার মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। তার চিন্তা-ভাবনাগুলো ছিল স্বচ্ছ। তিনি যা ভাবতেন, বিশ্বাস করতেন তা-ই তিনি অকপটে বলতেন। পরিণতিতে তার কি সমস্যা হতে পারে তিনি মোটেও ভাবতেন না। এর জন্য তাকে ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে।
সব সামরিক শাসনের বিরুদ্ধেই ছিল তার অবস্থান। যেখানেই গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ, সেখানেই তিনি অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে ছিলেন। সমস্ত সামরিক শাসক— জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল এরশাদের আমল থেকে শুরু করে খালেদা জিয়ার অপশাসন পর্যন্ত তার জীবনের উপরে প্রতি মুহূর্তে হুমকি এসেছে। এমনকি তার পেছনে দেশে-বিদেশে ঘাতক লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসবের কোনো পরোয়া তিনি কখনো করেননি। তার দেশে আসার পথে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। তিনি কিন্তু থোরাই তোয়াক্কা করেছেন সেসব। এমনকি তিনি কখনো যেকোনো সরকারের ভুল দেখানোর ক্ষেত্রেও অন্ধ স্তাবকের ভূমিকা পালন করেননি।
স্নেহের দাবি নিয়ে অনেক সময় তার কাছে পরামর্শ চাইতাম। কি লন্ডনে, কি দেশে; যেখানেই তিনি থাকতেন আমাকে পরামর্শ দিতেন। আমি তার তুলনায় নগণ্য হওয়ার পরও অনন্যটাই পেয়েছি তার কাছ থেকে। এমন মহীরুহ একটি দেশে যুগে যুগে জন্মায় না। আজকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শোকবার্তায় সেরকমই মন্তব্য করেছেন। আবদুল গাফফার চৌধুরী আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তার সৃষ্টি থাকবে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ
আরএ/