বেতন বাড়িয়ে দুর্নীতির মতো বিশাল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়
বাংলাদেশের প্রায় সকলখাতই কম বেশি দূর্নীতিগ্রস্ত। যে কারণে জনজীবনে অস্থিরতা বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কিছু অসাদুপায়ির হাতে বাজার চলে যাওয়া, কম মূল্যে কিনে বেশি মূল্যে বিক্রয় করাসহ প্রায় সকলক্ষেত্রেই নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটেছে। এই যে নৈতিকতার ঘাটতি এগুলি থেকে উত্তরণের জন্য সুনির্দিস্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। শুধুমাত্র বেতন বাড়িয়ে দুর্নীতির মতো এত বিশাল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
জীবনযাত্রার মানউন্নয়ন করতে বেতন ভাতা জীবনযাত্রার ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বৃদ্ধি করা উচিত। ২০১৫ সালে সরকার বেতন ভাতা বাড়িয়েছিল এবং বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখা হয়েছিল। আমরাও মনে করেছিলাম যে, এর একটি ইতিবাচক প্রভাব জীবনযাত্রায় পড়বে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র বেতনভাতা বৃদ্ধি করেই দূর্নীতি দূর করা যায় না। নীতিনৈতিকতার চর্চা বৃদ্ধি করা যায় না। শুভবুদ্ধি বৃদ্ধি করা যায় না। বেতনভাতা বাড়ানোর পাশাপাশি যেটি দরকার ছিল সেটি হল, ইতিবাচক বিষয়গুলির পাশাপাশি নেতিবাচক বিষয়গুলি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি দরকার ছিল। অর্থাৎ নিয়মভঙ্গ করলে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা এবং শাস্তি প্রদান করা ইত্যাদি। তাহলে কিন্তু সেটির একটি ইতিবাচক প্রভাব কাজের ক্ষেত্রে পড়তো।
দেশে অনিয়ন্ত্রিতভাবেই নীতি নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটেছে এবং ঘটছে। সরকারের বিভিন্ন মহল এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, বেতনভাতা বৃদ্ধি পেলে দূর্নীতি কমে যাবে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার ইতিবাচক ফলটা আমরা দেখতা পাই নাই। দেখা যায় যারা দূর্নীতি করেন, তাদের শাস্তি স্বরূপ সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়, বদলি করা হয়, যেগুলি আসলে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারে না অথবা তাদের ভিতরেও তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। কারণ তারা কিন্তু বেতন ভাতা সবই পায় যেকারণে তাদের ভিতরে অন্যায় করেও তেমন কোন পরিতাপ পরিলক্ষিত হয় না।
কাজেই সমাজ থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধের প্রথম শর্তই হচ্ছে মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন। একইসাথে আমি মনে করি, পারিবারিক শিক্ষা ও নীতি নৈতিকতার শিক্ষা খুবই জরুরি। সমাজ থেকে দূর্নীতি দূরীকরণে সমাজ ও রাস্ট্রের নাগরিকদের আইন ও নিয়মনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। অর্থ উপার্জনকারী কর্তার সমুদয় অর্থের হিসাব ও জবাবদিহিতা থাকতে হবে।
প্রশাসনিক স্বচ্ছতা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। সঠিক মনিটরিং সেলের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। কোন সরকারি কর্মকর্তা যেন অসাদুপায়ে উপার্জন করতে সক্ষম না হয়। কেউ যদি এ ধরণের অনৈতিক কাজ করে, তার বিরুদ্ধে দ্রুত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। আমাদের দেশে প্রশাসনিক আইন থাকলেও সেটি যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে দূর্নীতিকে মোক্ষম হাতিয়ার করে এরা অগ্রসর হচ্ছে। দূর্নীতিবাজদের নেটওয়ার্ক এত বেশি শক্তিশালী হয়েছে যে, কেউ যদি তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে, এবং সে যদি সরকারি কর্মকর্তা হয়ে থাকে, তাহলে তার দোষত্রুটি খুঁজে নিয়ে মিত্থা অপবাদ দিয়ে তাকে হেনস্তা করা হয়। একপর্যায়ে দূর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কথা বলার কোন রকম সুযোগই থাকেনা এবং এতে করে দূর্নীতিবাজরা দুঃসাহসি হয়ে উঠে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘুষ স্বজনপ্রীতি দূর্নীতি রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে অপেক্ষাকৃত মেধাবিরা দেশের পরিচালনায় গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারে না। অনেকেই মেধাবি হয়েও অভিমান করে দেশ থেকে চলে যায়।ফলে দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
কাজেই দেশপ্রেমিক হতে হবে। দেশপ্রেমিক নাগরিক কখনোই তার দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করার মানসিকতা পোষণ করেন না। সেই আঙ্গিকে দেশপ্রেমিক হলে দূর্নীতির প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।
কাজেই আমি মনে করি, সরকারি কর্মকর্তাদের শুধু বেতনভাতা বাড়িয়ে নয়, বরং প্রকৃত শিক্ষা, বিশেষ করে পারিবারিক শিক্ষা এবং কর্মক্ষত্রের জবাবদিহিতা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন, সর্বোপরি সামাজিক সুশাসন নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। তাহলেই কেবল বলা যায়, দেশকে দূর্নীতি মুক্ত রাখা সম্ভব।
লেখকঃ নির্বাহী পরিচালক [টি আই বি]