বঙ্গবন্ধুর পথনকশায় বাংলাদেশের এগিয়ে চলা
এই মুজিববর্ষ আর স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীর আনন্দ উদযাপনের মধ্যেই বাংলাদেশর স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হওয়া, করোনা মহামারির পরও দ্রুত মাথাপিছু আয়-বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার গতিশীল হওয়ার মতো ঘটনা আমাদের সামনেই ঘটেছে। আজ দেখছি সরকারের ‘গ্রামেও শহরের মতো সব সুবিধা’ নিশ্চিত করার নীতি-কৌশলের ফলে গ্রাম-বাংলার মানুষের আয়েরও শতকরা ষাট ভাগ আসছে অ-কৃষি খাত থেকে। তাই বলা যায়, স্বাধীনতার পাঁচ দশকে আমরা সত্যিই আমূল পাল্টে দিতে পেরেছি এদেশের মেহনতি মানুষের জীবনচলার চিত্রটি। চ্যালেঞ্জ তো এখনও আছে। তবু যে বিপুল ইতিবাচক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গেছে, বিশেষত গত এক যুগের কিছু বেশি সময় ধরে, তার স্বীকৃতি না দিয়ে তো উপায় নেই। এই অদম্য অগ্রযাত্রা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, স্বাধীন দেশে পা রেখেই। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে লাখো জনতা যখন তাঁকে বরণ করে নিচ্ছিল তখনই তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন যদি এদেশের মানুষ খেতে না পায়, যদি কর্মসংস্থান না হয় তাহলে স্বাধীনতা পূর্ণতা পাবে না। মাত্র চার বছরেরও কম সময়ে বহু বিশেষজ্ঞের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ‘এক্সপ্রেস ওয়ে’তে তুলে দিয়েছিলেন। ঐ অল্প সময়েই তিনি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে একটি শক্ত ভিত্তিই শুধু দিয়েছিলেন তাই নয়, বরং দ্রুত গতির এবং জনগণ-কেন্দ্রিক উন্নয়নের আগামীর পথনকশা জনগণের সামনে হাজির করে তিনি সকলকে আশাবাদিও করে তুলেছিলেন। সঙ্গত কারণেই তাই আমরা আফসোস করি, আর ভাবি-যদি বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হারাতে না হতো, তাহলে আমরা এতো দিনে নিশ্চয়ই আরও অনেক বেশি এগুতে পারতাম।
বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছি। মেগা-অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষি ও অ-কৃষি খাতের যুগল উন্নতির ফলে আমাদের প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ আর রপ্তানির পরিমাণ, মাথাপিছু আয়ের মতো সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকে যেমন তেমনি ক্ষুধা সূচক, মানুষের গড় আয়ু, জেন্ডার প্যারিটি ইনডেক্সের মতো সামাজিক সূচকগুলোতেও বাংলাদেশের পাঁচ দশকের সাফল্য এবং বিশেষ করে গত বারো-তেরো বছরের অর্জন এখন সহজেই বোঝা যায়। ১৯৭৫-এর পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৭ গুনেরও বেশি বেড়ে ২০২০ সালে দাঁড়ায় ১৬৬,৮৮৮ টাকায়। বেগবান এই অর্থনীতির গতিধারা থেকে এ কথা সহজেই বোঝা যায় যে, এর পেছনে কাজ করেছে সুবিবেচনাপ্রসূত নীতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতা। এই সামষ্টিক অর্থনৈতিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই জিডিপিতে কৃষির অবদান কমেছে। আর সে স্থান ক্রমান্বয়ে দখল করেছে শিল্প খাত। শিল্পখাতের প্রসার মানেই আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের প্রসার। বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত কম দক্ষ নারী কর্মীর ব্যাপক কর্মসংস্থান রপ্তানী-নির্ভর শিল্পায়নকেই শুধু প্রতিযোগী করেছে তাই নয়, দারিদ্র্য নিরসন এবং সামাজিক উন্নয়নেও তা নয়া মাত্রা যুক্ত করেছে। ফল স্বরূপ জিডিপিতে শিল্পের অবদান বেড়ে হয়েছে ৩৫ শতাংশ।
তবে উল্লেখ্য যে, জিডিপিতে কৃষির অবদান কমে আসলেও কৃষি উৎপাদন কিন্তু বেড়েছে। তার মানে কৃষিতে আধুনিকায়ন ঘটেছে। বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন সূচকের মান ২০১৬ সালের হিসাব অনুসারে ১৪৫.৩ (ভারতের ১৪৪, চীনের ১৩৯ এবং ভিয়েতনামের ১৩৬) । তবে কৃষি উৎপাদনের এমন নাটকিয় বৃদ্ধির পরও কিন্তু কৃষি মজুরি কমেনি বরং বেড়েছে। গ্রামীণ আয়ের বড় অংশটিই (৬০%) এখন আসছে অ-কৃষি খাত থেকে। দেশের গ্রামাঞ্চল এক দিকে বর্ধিষ্ণু শিল্প ও সেবা খাতের কাঁচা মাল ও মূল্য সংযোজিত পণ্য/সেবা সরবরাহ করছে, অন্য দিকে গ্রামাঞ্চলে মানুষের আয় বৃদ্ধির ফলে নতুন ভোক্তা হিসেবে তারা অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বৃদ্ধিতেও রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মোট কথা গোটা অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে একটি বড় মাত্রার স্বনির্ভরতা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে কৃষি ও শিল্পের যুগপৎ বিকাশের ফলে।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ধারাবাহিক উন্নয়নে সমর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত দশকে নাটকীয় অগ্রগতি অর্জনে সমর্থ হয়েছেন। আমাদের জিডিপির আকার বৃদ্ধি দ্রুত হয়েছে। বাহাত্তরের আট বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি এখন ৫২ গুণ বেড়ে ২০২১ সালের শেষে ৪১৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। তবে তারচেয়েও বেগবান রয়েছে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধির ধারা। তাই বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাত ক্রমশ বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত ছিল ২৬.৩, আর ২০১৮-১৯ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১.৬-এ। উল্লেখ্য যে, জিডিপির শতাংশ হিসেবে এই বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সরকার ও ব্যক্তি খাত উভয়ই ভূমিকা রেখেছে। তবে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ আরও দ্রুত হারে বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এসবের পাশাপাশি, গত ১০-১২ বছরে বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির যে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে সেটিও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একই সঙ্গে বেগবান করেছে এবং এর ঝুঁকি সহনক্ষমতা বাড়িয়েছে। বিশেষ করে সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে থাকা প্রান্তিক ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারি নাগরিকদের কাছে আর্থিক সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির উদ্ভাবনী নীতি উদ্যোগগুলো আশাতীত সুফল দিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে ব্যাংক হিসাবধারিদের এক-তৃতীয়াংশই এখন ডিজিটাল লেনদেন করছেন। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য গড়ে এ অনুপাত মাত্র ২৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অর্জন ও সম্ভাবনাগুলোকে বিবেচনায় নিয়েই কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বাংলাদেশের এমন সাফল্যের তিনটি প্রধানতম কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, তাঁর মতে বাংলাদেশের সরকার জাতীয় অগ্রযাত্রায় দেশের অ-সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে (অর্থাৎ এনজিওগুলোকে) কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে, ফলে সামাজিক পরিবর্তনে তারা সরকারের পরিপূরক ভূমিকা রাখতে পেরেছে কার্যকরভাবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিগত এক দশকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির যে নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে সেটিও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে বিশেষত অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে বলে তিনি মনে করেন। তৃতীয়ত, কৌশিক বসু মনে করেন যে, বাংলাদেশের তুলনামূলক তরুণ জনশক্তি এবং সস্তা শ্রমের সহজলভ্যতা দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির প্রধানতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সুফল সামাজিক পিরামিডের একেবারে পাটাতনে থাকা সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে সাফল্য। নীতি-নির্ধারকরা এদিকটিতে মনোনিবেশ করেছেন বলেই অতি-ধনীদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির ফলে আয় বৈষম্য কিছুটা বাড়লেও ভোগ বৈষম্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে। আর এর ফলে দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এ শতাব্দির শুরুতে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ এবং অতিদারিদ্র্য হার ছিল ৩৪ শতাংশ। দুই দশকের মধ্যে দারিদ্র্য হার অর্ধেকেরও বেশি কমিয়ে ২০ শতাংশের আশেপাশে এবং অতিদারিদ্র্য হার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি কমিয়ে ১০ শতাংশের আশেপাশে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে মহামারিজনিত অচলাবস্থার ফলে এ দুটি হার ইতোমধ্যে বেড়েছে। তবুও মহামারির আগে এ হারগুলো কমিয়ে আনার কৃতিত্ব সুবিচেনাপ্রসূত সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিকেই দিতে হবে। এবং এর জোরেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য হ্রাসে আগের ধারাবাহিকতায় ফেরা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন নীতি নির্ধারক মহল। সমকালিন ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা কতোটা দীর্ঘায়িত হয় তার ওপর এই আশাবাদের বাস্তবায়ন বহুলাংশে নির্ভরশীল। তবে পদ্মা সেতু, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ মেগা-অবকাঠামো প্রকল্পগুলো সময় মতো বাস্তবায়ন করা গেলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিকাশ আরও গতিময় হবে।
বাংলাদেশকে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথেই হাঁটতে হবে তা আমাদের জাতির পিতা শুরুতেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। ১৯৭২-এর ০৯ মে তিনি বলেছিলেন-“আমি কী চাই? আমি চাই বাংলার মানুষ পেট ভরে খাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক।” বঙ্গবন্ধুর মুখনিসৃত এ বাক্যগুলোর মাধ্যমে মুক্তির সংগ্রামে নিয়োজিত জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা যেভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে তা সম্ভবত আর কোথাও পাওয়া যাবে না। আজকে আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। করোনা মহামারির ধাক্কা যখন সবে কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছি, তখনই উদয় হয়েছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্য বৃদ্ধির চাপ। দেশের ভেতরেও কতিপয়তন্ত্র আর দূর্নীতি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে। সর্বোপরি রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথনকশা বুকে ধারণ করে এ দেশবাসী বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে এই চ্যালেঞ্জগুলোও মোকাবেলা করে দেশকে এগিয়ে নেবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।