আবারও এশিয়ার রাজা শ্রীলঙ্কা
হার দিয়ে শুরু। জয় দিয়ে শেষ। কিন্তু শেষ জয়টার মাহাত্ব্য অনেক বেশি। এই জয়, শুধু একটি জয় নয়। এই জয় এনে দিয়েছে এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। মুকুট পড়েছে শ্রীলঙ্কা। মুকুট পরে ৮ বছর পর হয়েছে আবার এশিয়ার রাজা। আর এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে গিয়ে তারা পাকিস্তানকে হারিয়েছে ২৩ রানে।
টস হেরে ব্যাট করতে নেমে শ্রীলঙ্কা ৬ উইকেটে ১৭০ রান করে। জবাব দিতে নেমে পাকিস্তান শেষ বলে অলআউট হয়ে করে ১৪৭ রান। শ্রীলঙ্কার এটি ছিল ষষ্ঠ শিরোপা। পাকিস্তান হলো তৃতীয়বারের মতো রানার্সআপ। প্রতিবারই তারা শ্রীলঙ্কার কাছে হেরেছে।
শ্রীলঙ্কার জন্য এই শিরোপাটি ছিল যেন বহুল কাঙ্খিত। প্রথমে করোনা, পরে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে স্বাগতিক হওয়ার পর একান্ত ইচ্ছে থাকা সত্তেও আয়োজন করতে পারেনি। স্থানান্তরিত হয় মরুর বুকে। এই শিরোপা তাই তাদের দুর্দশায় থাকা জনগনের জন্য এক পশলা শান্তির বৃষ্টি এনে দেবে।
শ্রীলঙ্কা যে শিরোপা জিতবে তা কিন্তু আসর শুরু দেখে বুঝার উপায়ই ছিল না। আফগানিস্তানের কাছে মাত্র ১০৫ রানে অলআউট হয়ে হেরেছিল খুবই বাজেভাবে। আফগানিস্তান জিতেছিল ১০.১ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে। ধ্বংসস্তুপের মাঝখান থেকে ঘুরে দাঁড়ায় শ্রীলঙ্কা। পরে আর একটি ম্যাচও হারেনি। আফগানিস্তানের কাছে গ্রুপ পর্বে বাজেভাবে হারের প্রতিশোধ নেয় সুপার ফোরে আফগানিস্তানের ৬ উইকেটে করা ১৭৫ রান টপকে ৪ উইকেটে ম্যাচ জিতে। কিন্তু পাকিস্তান আর প্রতিশোধ নিতে পারেনি। ফাইনাল আগেই নিশ্চিত হয়ে যাওয়াতে দুই দলে সুপার ফোরের নিয়ম রক্ষার ম্যাচে শ্রীলঙ্কার কাছে পাকিস্তান হেরেছিল মাত্র ১২১ রান করে ৫ উইকেটে। সুপার ফোরের মতো ফাইনালেও তারা শ্রীলঙ্কার সামনে লড়াই করতে পারেনি।
ফাইনাল ম্যাচ যেমন জমজমাট হবে বলে ধারনা করা হয়েছিল, তার ছিটেফোঁটাও হয়নি। এই না হওয়ার কারণ পাকিস্তানের ব্যাটিং ব্যর্থতা। গোটা আসরেই একমাত্র ভারতের বিপক্ষে সুপার ফোরে তারা ১৮১ রান অতিক্রম করে জিতেছি। এ ছাড়া আফগানিস্তানের ১২৯ রান তাড়া করতে গিয়ে তারা কোনো রকমে পার পেয়েছিল। সুপার ফোরের আরেক ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আগে ব্যাট করে মাত্র ১২১ রানে অলআউট হয়েছিল। ফাইনালেও তারা অলআউট হয়েছে।
গোটা আসরে পাকিস্তানের ব্যাটিং ব্যর্থতার মাঝে যেমন উজ্জল ছিলেন ওপেনার মোহাম্মদ রিজওয়ান। ফাইনালেও তিনি একইভাবে দলের হয়ে দ্যুতি ছড়িয়েছেন এককভাবে ৪৯ বলে ৫৫ রানের ইনিংস খেলে। এটি ছিল আসরে তার তৃতীয় ও ক্যারিয়ারে ১৬তম ফিফটি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ছিল ইফতেখার আহমেদের ৪৩। আগের ম্যাচে এই পাকিস্তানের বিপক্ষেই অভিষেকে নজর কাড়ার পর এই ম্যাচেও প্রমোদ মাদুসানের তোপে পড়ে দলীয় ২২ রানের মাঝে বাবর আজম (৫) ও ফখর জামান (০) ফিরে যাওয়ার পর এই দুই ব্যাটসম্যান যখন জুটি বেঁধে এগুচ্ছিলেন, তখন পাকিস্তান ম্যাচেই ছিল। একটি জমজমাট ফাইনালের দিকে এগুচ্ছিল ম্যাচ। ৯.৫ ওভারে ৭১ রান যোগ করে এই জুটি দলকে ২০১২ সালের পর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন। জুটি যখন ক্রমেই বিপজ্জন হচ্ছিল, তখন অধিনায়ক শানাকা ফিরে যান আবার প্রমোদ মাদুসানের কাছে। আস্থার প্রতিদান দেন ইফতেখারকে আউট করে।
এই জুটি ভেঙ্গে যাওয়ার পর যেন পাকিস্তানের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখার বাধ ভেঙ্গে পানি ঢুকে যায়। ক্রিজে ব্যাটসম্যানরা হয়ে উঠেন কচু পাতার পানি। হাসারাঙ্গা ডি সিলভা এক ওভারে পাকিস্তানকে স্বপ্ন দেখানোর নায়ক মোহাম্মদ রিজওয়ানসহ আসিফ আলী ও খুশদিল শাহকে আউট করে ম্যাচ থেকে ছিটকে ফেলে দেন পাকিস্তানকে। ৩.২ ওভারে ১৯ রানে হারায় ৫ উইকেট। এরপর ম্যাচের বাকিটা ছিল শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। প্রমোদ মাদুসান ৩৪ রানে ৪টি, হাসারাঙ্গা ২৭ রানে ৩টি ও চামিকা করুনারত্ন ৩৩ রানে ২টি উইকেট নেন।
টস হেরে ব্যাট করতে নামা মানেই যে ব্যাটিং বিপর্যয়,তা কিন্তু নয়। মূল ভয় রান হাই স্কোরিং, লো স্কোরিং যেটিই হোক না কেন, সেটি নিরাপদ থাকে না। চেজ করতে নেমে যতই বিপর্যয় ঘটুক না কেন, তরি শেষ পর্যন্ত তীরে ভিড়েই। শ্রীলঙ্কার ৬ উইকেটে করা ১৭১ রান নিরাপদ মনে না হলেও অন্তত লড়াই করার মতো। কিন্তু এই রানও হওয়ার কথা ছিল না। ব্যাট করতে নামার পরই ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়ে পাওয়ার প্লে শেষ হওয়ার আগেই ৫.১ ওভারে ৩৬ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে। নাসিম শাহ ও হারিস রউফের তোপে পড়ে লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের ত্রাহী ত্রাহী অবস্থা। প্রথম ওভারেই নাসিম শাহর দুর্দান্ত ইনসুংইয়ে কুশাল মেন্ডিস (০) স্ট্যাম্প উপড়ে যায়। হারিস রউফও স্ট্যাম্পে আঘাত হানেন পাথুন নিশানকা (৮) ও ধানুশকা গুনাথিলকাকে (১) আউট করেন। একটু পর ফিরে যান ধনাঞ্জায়া ডি সিলভা (২১ বল ২৮ রান) ও অধিনায়ক দাসুন শানাকা (২)। ৮.৫ ওভারে ৫৮ রানে নেই ৫ উইকটে। ভয়াবহ বিপর্যয়ে শ্রীলঙ্কা।
প্রথম ম্যাচে বাজেভাবে হারের পরও শ্রীলঙ্কা পরে আর কোনো ম্যাচ না হেরে ফাইনাল পর্যন্ত এসেছে নির্দিষ্ট করে কারও উপর নির্ভর করে নয়। বিপর্যয়ে ব্যাট হাতে যেমন কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে গেছেন, তেমনি বল হাতেও। এবার দলের ব্যাটিং বিপর্যয়ে দাঁড়িয়ে যান ‘ম্যান অব দ্যা ফাইনাল’ ভানুকা রাজাপাকসে। তার ব্যাটিং তান্ডবে প্রাণ ফিরে পায় লঙ্কারা। সঙ্গি হিসেবে পেয়ে যান হাসারাঙ্গা ডি সিলভাকে। দুই জনে ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ৬ ওভারে যোগ করেন ৫৮ রান। হাসারাঙ্গা মাত্র ২১ বলে ১ ছক্কা ও ৫ চারে ৩৬ রানের কার্যকরি ইনিংস খেলে দিয়ে যান। হাসারাঙ্গা যখন অগ্নিমুর্তি ধারন করেছেন, অপরপ্রান্তে রাজাপাকসে তখনও রুদ্রমূতি ধারন করেননি। হাসারাঙ্গা আউট হওয়ার সময় তার রান ছিল ২৮ বলে ৩৭। এরপর শুরু হয় তার রুদ্রমুর্তি ধারন। চামিকা করুনারত্নের সঙ্গে সপ্তম উইকেট জুটিতে অবিচ্ছিন্ন যে ৫৪ রান আসে, সেখানে চামিকার অবদান ছিল ১৪ বলে ১৪ রাজাপাকসে বকি ১৭ বল খেলে যোগ করেন ৩৪ রান। আগে যেখানে কোনো ছক্কা ছিল না, সেখানে তিনি ৩টি ছক্কা মারেন। একাধিকবার জীবন পেয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি ৪৫ বলে ৩ ছক্কা ও ৬ চারে ৭১ রান করে অপরাজিত থাকেন। ৩৫ বলে করেন ক্যারিয়ারের তৃতীয় হফ সেঞ্চুরি। এবারের আসরে এটিই তার প্রথম সেঞ্চুরি। হাসান রউফ ২৯ রানে নেন ৩ উইকেট। ১টি করে উইকেট নেন নাসিম শাহ, সাদাব খান ও ইফতেখার আহমেদ।
এমপি/এএস