আলোর সন্ধানে গিয়ে মেলে অন্ধকার জীবন
শরীয়তপুরের নাজমা বেগম। বয়স ৩৮। অভাবের সংসার তার। স্বামী আক্কাস আলী শারীরিক অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন কর্মহীন রয়েছেন। এমন সময় স্থানীয় এক দালালের কাছ থেকে সৌদি আরবে ভালো বেতনে চাকরির প্রস্তাব পান। ভালো উপার্জনের আশায় স্বামী-সন্তান দেশে রেখে পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে। এরপর সবকিছু ওলট-পালট হতে শুরু করে। আলোর সন্ধানে গিয়ে মেলে অন্ধকার জীবন।
নাজমা বেগম জানান, মধ্যপ্রাচ্যে ভালো কাজের কথা বলে তাকে গিয়ে দাসত্বের শৃংখল পরানো হয়েছে। যেখানে ভালো খাবারের আশা ছিল তার, সেখানে জুটেছে বৈদ্যুতিক শকসহ শারীরিক নানা নির্যাতন। পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ তৎপরতায় নাজমা বেগম দেশে ফিরতে পারলেও এখনও সেখানে নির্মম নির্যাতনের মধ্যে দিন পার করছেন দীপ্তি আক্তার ও মোছা. রোকসানা আক্তার নামের দুই নারী।
নাজমার ভাষ্য অনুযায়ী, ওই দুজন শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ এবং তাদের পক্ষে সাধারণ চলাফেরা করাও অসম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত তাদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন পাচারের পর ফিরে আসা এই নারী।
ভালো কাজের চুক্তিতে সৌদি আরব যাওয়া এবং সেখানে অবস্থানকালীন ৬ মাস ১৬ দিনে তার সঙ্গে কি কি হয়েছে ঢাকাপ্রকাশের কাছে তা তুলে ধরেন নাজমা। তিনি জানান, সেখানে যাওয়ার পর জানতে পারেন তাকে পাঁচ লাখ টাকায় কিনে নিয়েছেন রিয়াদের এক পরিবার। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রিয়াদে। সেখানে তাকে প্রথমে একটি বাসায়, তারপর আরেকটি বাসায় নেওয়া হয়। সেখানে তার ওপর চলে নির্মম নির্যাতন।
নাজমা জানান, তাকে সেখানে খাবার দেওয়া হতো না। বাথরুম ব্যবহার করতে দেওয়া হতো না। নিয়মিত বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো তাকে, করা হতো নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতন!
নির্মম নির্যাতনের এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন নাজমা। প্রাণ বাঁচাতে ওই বাসা থেকে পালিয়ে সে দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হন। কিন্তু তাতেও রক্ষা পাননি তিনি। সৌদি আরবের যে প্রতিষ্ঠান তাকে বিক্রি করেছিল, নাজমাকে তাদের হেফাজতে দেওয়া হয়। এরপর নাজমার ওপর শুরু হয় আরেক দফা নির্যাতন! পরে কৌশলে নির্যাতনের বিষয়টি দেশে তার পরিবারের সদস্যদের জানালে তারা র্যাবের কাছে অভিযোগ করেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব তাকে দেশে ফিরিয়ে আনে।
র্যাবের তৎপরতায় নাজমা দেশে ফিরতে পারলেও তিনি সেখানে রেখে আসা দুই নারী দীপ্তি আক্তার এবং রোকসানা আক্তারের কথা ভুলতে পারছেন না। তাদের শারীরিক অবস্থা জানাতে গিয়ে নাজমা বলেন, ‘একের পর এক বিক্রি হয়ে প্রতিনিয়ত নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন ওই দুজন। বর্তমানে তারা দুজন শারীরিকভাবে অত্যন্ত অসুস্থ এবং তাদের পক্ষে সাধারণ চলাফেরা করা অসম্ভব।’
নাজমাকে ফিরিয়ে আনার পর র্যাব জানায়, তার পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-৪ তিন নারীকে দেশে ফেরত আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর ফলশ্রুতিতে আল-আরাফা ট্রাভেলস এজেন্সির মাধ্যমে যোগাযোগ করে নাজমা বেগমকে বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। অন্য দুই নারীকেও ফেরত আনার বিষয়ে চেষ্টা চলছে।
পাচার হওয়া কমবয়সী নারীদের গন্তব্য দুবাইয়ের ডিজে পার্টি
আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের দেশীয় এজেন্টরা চষে বেড়ান জেলা থেকে উপজেলা, গ্রাম থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সন্ধান করেন দরিদ্র পরিবারের তরুণীদের। এরপর দুবাইতে গার্মেন্টে চাকরির কথা বলে তাদের নিয়ে আসেন ঢাকায়। এখানে চলে কয়েক দিনের গ্রুমিং সেশন। সৌন্দর্য্য চর্চার পাশাপাশি শেখানো হয় নাচ-গান।
সকল সেশন শেষ হওয়ার পর এসব তরুণীকে পাঠানো হয় দুবাইয়ে। সেখানে এই আন্তর্জাতিক চক্রের অন্য সদস্যরা আগে থেকে অপেক্ষা করেন। তারা মূলত দেশ থেকে পাঠানো কমবয়সী নারীদের রিসিভ করে নিয়ে যান সেইফ হাউজে। এরপর তাদের দুবাইয়ের বিভিন্ন হোটেলে ডিজে পার্টিসহ অনৈতিক বিভিন্ন কাজে লিপ্ত করেন।
সম্প্রতি এই চক্রের সক্রিয় এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তার নাম মো. শামসুদ্দিন। বাড়ি নারায়াণগঞ্জে। গ্রেপ্তারের আগে তিনি শতাধিক তরুণীকে এই প্রক্রিয়ায় দুবাই পাঠিয়েছেন বলে র্যাবের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের এই সদস্যকে গ্রেপ্তারের সময় পাচারের অপেক্ষায় থাকা এক নারীসহ চার জনকে উদ্ধার করা হয়। পাচারের অপেক্ষায় থাকা ওই তরুণী জানান, তাকে দুবাইয়ের এক গার্মেন্টে লাখ টাকা বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ঢাকায় আনেন শামসুদ্দিন। পরে নারায়ণগঞ্জের একটি বাসায় রাখা হয়। নেওয়া হয় বিউটি পার্লারে। এরপর শেখানো হয় নাচ-গান। বিষয়টি সন্দেহ হলে তিনি শামসুদ্দিনের কাছে এসবের কারণ জানতে চান। তখন শামসুদ্দিন তাকে বলেন, দুবাই অনেক সুন্দর দেশ, সেখানে যেতে হলে সুন্দর হয়ে যেতে হয়। এ জন্য এসব প্রস্তুতি।
শামসুদ্দিনকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানায়, নারী পাচারের এই আন্তর্জাতিক চক্রের মূল হোতার নাম জিয়া। তিনি দুবাই থাকেন। তার হয়ে দেশ থেকে তরুণী সংগ্রহের কাজটি করে থাকেন শামসুদ্দিন। জিয়া মূলত এসব তরুণীদের দুবাইয়ের বিভিন্ন হোটেলে ডিজে পার্টিসহ অন্য অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করেন।
দুবাইয়ে নারী পাচারের আন্তর্জাতিক এই চক্রের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন র্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন। তিনি বলেন, শামসুদ্দিন এ পর্যন্ত শতাধিক নারীকে বিদেশে পাচার করেছেন। এ চক্রটি দুবাই, সিঙ্গাপুর এবং ভারতে নারী এবং পুরুষদের পাচার করে আসছে। এখন পর্যন্ত প্রায় শতাধিক নারী পুরুষকে পাচার করেছে এ চক্রটি। যেসব নারী বিদেশে যেতে ইচ্ছুক তাদের জনপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে দেওয়া হতো। অন্যদিকে পুরুষদের কাছ থেকে নেওয়া হতো জনপ্রতি তিন থেকে চার লাখ টাকা করে। দুবাইতে ড্যান্স ক্লাবে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হতো তরুণীদের। এ চক্রটি জাল এম্প্লয়মেন্ট কার্ড ও বিএমইটি কার্ড তৈরি করত কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছাড়াই।
পাচার হওয়া কম বয়সী নারীদের নেওয়া হয় প্রতিবেশী দেশের হোটেলে
কম বয়সী মেয়েদের মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপের দেশগুলোতে পাচার করতে গেলে পাসপোর্ট ও ভিসার জটিলতা তৈরি হয়। এ ধরনের জটিলতা এড়াতে কম বয়সী নারীদের পাচার করা হয় প্রতিবেশী দেশে। সেখানে বিভিন্ন হোটেলে তাদের দিয়ে অনৈতিক কাজ করানো হয় বলে তথ্য পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্যমতে, নারী পাচারের চক্রটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে দরিদ্র পরিবারের নারীদের টার্গেট করে। এদের মধ্যে কম বয়সী নারীদের পাচার করা হয় প্রতিবেশী দেশে। পাচারের আগে তাদের ঢাকায় এনে নাচ-গান শেখানো হয়। তারপর তাদের নেওয়া হয় সীমান্তবর্তী জেলা যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহে। এরপর তাদের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন সেফ হাউজে নিয়ে রাখা হয়। সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে লাইনম্যানের মাধ্যমে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করানো হয়। পরে পার্শ্ববর্তী দেশের এজেন্টরা তাদের গ্রহণ করে সীমান্ত নিকটবর্তী সেফ হাউজে রাখে। সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে কলকাতার সেফ হাউজে পাঠানো হয় এসব কম বয়সী নারীদের। এর পরের ধাপে কলকাতা থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের বেঙ্গালুরু নিয়ে সেখানে বিভিন্ন হোটেলে তাদের দিয়ে অনৈতিক কাজ করানো হয়।
ভারতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর চলতি বছরের শুরুতে নতুন করে বিষয়টি সামনে আসে। ওই ঘটনায় ভারতের পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে, যার মধ্যে রয়েছে ঢাকার মগবাজারের বাসিন্দা রিফাদুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয়। পরে পুলিশ ও র্যাব নারী পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে দুটি চক্রের ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে। শুধু এই দুই চক্র পাঁচ বছরে প্রায় দুই হাজার নারীকে ভারতে পাচার করেছে বলে পুলিশ ও র্যাব জানায়।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তথ্য বলছে, এ বছরের প্রথম দশ মাসে সীমান্ত দিয়ে পাচারের সময় ৯২ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে ৪৩ জন নারী, পুরুষ ৪১ জন এবং শিশু ৮ জন। এ সময় ১৬ জন পাচারকারীকে আটক করা হয়। মামলা দেওয়া হয় ৩৪টি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘পাচার চক্রের সদস্যরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সুন্দরী তরুণীদের ঢাকায় নিয়ে আসত। পরে নাচ-গান শেখানোর পাশাপাশি তাদের বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তুলত। এরপর ভালো বেতনে চাকরির কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করত। পাচারের পর তাদের দিয়ে অনৈতিক কাজ করান হতো। পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
এনএইচ/এএন