প্রশ্নবিদ্ধ সাংবাদিকতা: উত্তরণের পথ (৩)
গোপন সমঝোতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সাংবাদিকতা
উপমহাদেশে সাংবাদিকতা অনেকটাই স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গড়ে উঠলেও বিষয়টি পেশাদারিত্বে গড়াতে খুব বেশি সময় নেয়নি। যখনই সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে গড়ে উঠেছে, তখনই পেশার মধ্যে প্রতিযোগিতা এসেছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি সাংবাদ মাধ্যম ও কলমের স্বাধীনতা–এ দুটিই বার বার হুমকির পড়েছে। রাষ্ট্র, করপোরেট পুঁজি, স্বজন-তোষণ, এমনকি আমাদের সংবাদ মাধ্যমের অনেকের মেরুদণ্ডহীনতার দায় এ বিষয়ে এড়ানো কঠিন। এসব বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হওয়া সাংবাদিক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের। তাদের মতামতের ভিত্তিতে ‘প্রশ্নবিদ্ধ সাংবাদিকতা: উত্তরণের পথ’ শীর্ষক ঢাকাপ্রকাশের ধারাবহিক এ আয়োজনের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।
গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন এবং আইনের শাসন নিশ্চিতের অন্যতম হাতিয়ার বস্তুনিষ্ঠ, সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতা। তবে বর্তমান সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে অনেকটা ঘাটতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন সাংবাদিক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা। আর পেশাদারিত্বের ঘাটতির জন্য সরকারি নিয়ন্ত্রণ, করপোরেট মালিকানা, আর্থিক ও পেশাগত অনিরাপত্তা এবং সাংবাদিকদের রাজনৈতিক বিভাজনকেই অনেকটা দায়ী মনে করছেন তারা।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেন, ‘গণমাধ্যমের পেশাদারিত্বের জন্য পেশাদার সম্পাদক প্রয়োজন। স্বাধীন সংবাদ প্রবাহ নিশ্চিত করতে একটি সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান দরকার। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হবেন একজন সম্পাদক। এটি প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে পেশাদারিত্বের সংকট কাটিয়ে ওঠা প্রায় দুঃসহ ও কষ্টকর হয়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাতারাতি সম্পাদক হওয়া আর অভিজ্ঞতালব্ধ সম্পাদক হওয়ার মধ্যে তফাৎ থাকে। জনস্পন্দন বুঝে সে অনুয়ায়ী সংবাদ পরিবেশন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, দৈনন্দিন নির্মোহ সাংবাদ পরিবেশেন শুধু পেশাদার সাংবাদিক বা সম্পাদকের তত্ত্বাবধানে সম্ভব।’
একই সঙ্গে ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিতের বিষয়ে জোর দিয়ে এ সাংবাদিক নেতা বলেন, ‘শুধু পরিচয়পত্র দিয়ে ছেড়ে দিলে ভালো সাংবাদিকতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। বেতন কাঠামো, সাংবাদিকদের পেশাগত মর্যাদা ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করতে হবে।’
‘এ ছাড়া কারা অসত্য, অর্ধসত্য তথ্য দেয়, গুজব ছড়ায় সে বিষয়ে নজরদারি করা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটি মৌলিক কাজ হওয়া উচিত। কোনো সংবাদ গোপন রাখা বা অসত্য, অর্ধসত্য তথ্য দিয়ে নিউজ তৈরি করা–এগুলো সংবাদের অবাধ স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে।’ এতে পেশাদারিত্বের অভাব দেখা দেয় বলেও মনে করেন এ সাংবাদিক।
গণমাধ্যমের পেশাদারিত্ব বজায় থাকলে এর সুফল ভোগ করে রাষ্ট্রের সর্বস্তরের নাগরিক ও পেশাজীবী। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ ও অধিকার কর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘যদি সাহসী ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা আমাদের সঙ্গে থাকে, তাহলে কাজ অনেক সহজ হয়। যখন একটি ন্যাস্ত স্বার্থগোষ্ঠীকে আমরা আঘাত করি, বিষয়টিকে নীতিনির্ধারণী মহলে পৌঁছে দেয় গণমাধ্যম। তখন আমাদের কাজ সহজ হয়। আর যদি সাংবাদিকতা জিম্মি হয়ে পড়ে অর্থনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে বা রাজনৈতিক শক্তির কাছে, তাহলে যে কোনো ন্যায়বিচার রক্ষার যাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আজকাল সাংবাদিকতায় বড় বিনিয়োগকারীরা আসেন। তাদের স্বার্থ কখনও প্রকাশ্যে থাকে, কখনও অদৃশ্য থাকে। সেই স্বার্থের কারণে সাংবাদিকদের সেলফ সেন্সরশিপের চলে আসে। কারণ সেখানে তার চাকরির ঝুঁকি থাকে।’
গণমাধ্যমের করপোরেট মালিকানার প্রসঙ্গে ডিবিসি নিউজের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা মিডিয়া প্রতিষ্ঠান করে। এজন্য নিজেদের প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির খবর তো প্রকাশ করবেই না, অন্য প্রতিষ্ঠানেরটাও প্রকাশ করতে পারবে না। কারণ এক প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি-অনিয়মের খবর বের করলে, সেই প্রতিষ্ঠানও পাল্টাপাল্টি বের করবে। সে কারণে সাংবাদিকতা এখন গোপন সমঝোতা, নিরব সমঝোতা, এক ধরনের আপসের মধ্য দিয়ে চলছে। যে কারণে আমরা সমাজের অনেক অনিয়ম, অনাচার ও অন্যায্য ঘটনার চিত্র আমরা তুলে ধরতে পারছি না।’
আগে এরকম বিষয় থাকলেও এখন মাত্রাটা বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগে সাংবাদিকতার সঙ্গে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য স্পষ্ট ছিল। পাকিস্তান আমলে আমরা দেশ স্বাধীনের মোটো নিয়ে কাজ করেছি, স্বাধীনের পর দেশ গঠনের মোটো নিয়ে কাজ করেছি। এরপর সামরিক স্বৈরাচার ঢুকে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করেছে। পরে আবার গণতন্ত্র এসেছে। গণতন্ত্রের পাশাপাশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বেড়েছে। আঘাত এসেছে সংবাদপত্রের নীতির উপরও। এটি বাণিজ্যিক চাপ।’
তিনি আরও বলেন, ‘মালিকানা সবসময় ব্যবসায়ীদের হাতেই থাকবে। কারণ পত্রিকা বা টেলিভিশন করতে চাইলে মোটা টাকার দরকার। একজন সাংবাদিক এত টাকা কোথায় পাবে? কোনো বিনিয়োগকারীর কাছে যেতেই হবে। তবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের চালক হবেন না। পত্রিকা চালানোর জন্য প্রফেশনাল লোক নিয়োগ দিতে হবে। আর প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলবে, তা ঠিক করবেন প্রতিষ্ঠানের সেই চালক।’
জ্যেষ্ঠ এ সাংবাদিকের মতে, টেলিভিশন বা পত্রিকায় বিনিয়োগকারীরা দৃশ্যমান থাকবেন না। পেশাদার লোকজন প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নেবেন।
তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান যদি সত্য কথা লিখে ও বলে, সত্য তথ্য তুলে ধরে, জনগণের চাহিদা মাফিক তথ্য দেয়, তাহলে সেই টেলিভিশন মানুষ দেখবে, পত্রিকা মানুষ পড়বে। প্রত্রিকা যখন বেশি মানুষ পড়বে, তখন রাজস্ব আসবে, পাঠক বেশি হবে; দর্শক বেশি হবে, ওখানে বিজ্ঞাপনও বেশি আসবে। এভাবেই একটা প্রতিষ্ঠান টিকে থাকবে।’
এ গণমাধ্যম গবেষক আরও বলেন, ‘এমন ব্যবসায়িক নীতি মালিকরা করে দেন না, মালিকরা সামনে চলে আসেন। এখানে বোর্ড অব ডিরেক্টরস বা সম্পাদকীয় বোর্ডের মালিকের সঙ্গে একটি চুক্তি থাকতে হবে যে, সাংবাদিকতা বিষয়ক কোনো কিছুতে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। সম্পাকীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে না পারলে মালিকদের জিম্মি দশা থেকে সাংবাদিকতাকে বের করা সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘গণতান্ত্রিক পরিবেশ, আইনের শাসন যদি থাকত, রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান যদি শক্তিশালী হতো তাহলে কারও অনিয়ম-দুর্নীতি তুলে ধরলে, আপনার বিরুদ্ধে কেউ ব্যবস্থা নিতে পারত না। সরকারের কোনো বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারত না। আপনার বিজ্ঞাপন কমিয়ে দেওয়া, সার্কুলেশনে আঘাত করতে, আপনার সাংবাদিককে হয়রানি করতে পারত না। তখন আপনি নিজেও অনিয়ম করতে পারতেন না।’
তিনি বলেন, ‘তবে এর মধ্যেও কিছু কিছু অনিয়ম, দুর্নীতি তুলে ধরা হচ্ছে। সেসবের কারণে সরকার কিছু বিষয় মেনেও নিচ্ছে। এটা আরও সম্ভব হতো যদি সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারতাম।’
কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘মালিকপক্ষের একটা শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ দেখা যাচ্ছে। তাদের যে কোনো ধরনের অপরাধ সংঘটিত হলে, সেগুলোর সমর্থনেও পত্রপত্রিকা নেমে যাচ্ছে। সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার অথবা তাদের ভেতরের কোনো অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা উপায় হলো গণমাধ্যম।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে পাকিস্তানের মতো অত্যন্ত নিয়ন্ত্রণকামী পরিবেশে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে খুব বড় মাপের কিছু সংখ্যক সাংবাদিক সংগ্রাম করেছেন এবং স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন। সাংবাদিকদের সাহস ছিল। এখন সেখানে কিছুটা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। যদি সব সাংবাদিক সততার পক্ষে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে যেতেন, তাহলে সরকার অনেক কিছু মেনে নিতে বাধ্য হতো। এটা নির্ভর করছে–সাংবাদিকরা কতটা সংগঠিত তার ওপর।’
তবে সব মালিকপক্ষকে এক দাগে ফেলতে রাজি নন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তার মতে, ‘অনেক ভালো মালিক আছেন। ঢালাওভাবে খারাপ বললে, ভালো মানুষকে নিরুৎসাহিত করা হয়।’
দৈনিক সংবাদের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘সংবাদের মালিকপক্ষ কখনো কোনো চাপ সৃষ্টি করেছে বলে শুনিনি। সংবাদ এখনো তার সম্পাদকীয় নীতিতে অবিচল আছে। একটি মালিকপক্ষ যদি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে অন্য কেউ কেন পারবে না।’
তবে এটি না পারার জন্য অস্বচ্ছ বা অবৈধ বিনিয়োগও দায়ী বলে মনে করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘যদি কেউ মানুষকে ঠকিয়ে নিজের উপরি পাওনা বিনিয়োগ করে, তখন মালিকের নিয়ন্ত্রণ থাকে। এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্র সংশ্লিষ্টরা শুরুতেই চুক্তি করতে পারে, স্বাধীন সাংবাদিকতায় কোনো বাধা দিতে পারবে না এবং মালিক হলেই সম্পাদক হওয়া যাবে না। এ ছাড়া কোনো গ্রুপ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চাইলে, তাদের অতীত ইতিহাসও দেখতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ ছিল কি-না।’
সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্বের ঘাটতির ক্ষেত্রে মার্কেটিং বিভাগের মাতবরি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ডিবিসি সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু। তিনি বলেন, ‘এখন মার্কেটিং বিভাগ ঠিক করে সাংবাদিকতা কী হবে, না হবে। একজন চিফ রিপোর্টার অ্যাসাইনমেন্ট দেবেন, তার মধ্যে মার্কেটিং থেকে আসে ২/৩টি, আবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে আসে ২/৩টি।’
রিপোর্টারদের বিজ্ঞাপন সংগ্রহের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অপেশাদারসূলভ আচরণ। এগুলো আইন করে বন্ধ করা যাবে না। তবে প্রতিষ্ঠানের নিয়মনীতি ও আচরণবিধি থাকতে হবে। এটা সরাসরি অনিয়ম। আচরণবিধি লঙ্ঘন।’ পেশাদারিত্ব বাড়ানোর জন্য তিনি বিনিয়োগ, প্রশিক্ষণ, মোটো, ভিশন, মিশনের ওপর জোর দেন।
একই কথা বললেন অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘যদি একজন রিপোর্টার সংবাদ পাঠানো ও বিজ্ঞাপন সংগ্রহের দায়িত্বে থাকেন, তাহলে স্বার্থের দ্বন্দ্ব (কনফ্লিক্ট অব ইন্টরেস্ট) তৈরি হয়।’
পেশাদারিত্বের উন্নয়নের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তথ্য, ভুল তথ্য ও অপতথ্যের পার্থক্য বুঝতে হবে। সরকার ও সাংবাদিক নেতাদের যৌথভাবে কাজ করতে হবে।’
এসএ/