জামায়াত নিয়ে সিদ্ধান্তহীন বিএনপি
১৯৯৯ সালে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিকভাবে জোটবদ্ধ হয়ে এখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে অন্যতম শরীকদল। নির্বাচন কমিশন কৃর্তক নিবন্ধন আইনি জটিলতায় দলটির দৃশ্যত কোনো কার্যক্রম নাই বললেই চলে। তবে বিএনপির কার্যক্রম সম্পর্কে ক্ষমতাসীনদের আলোচনা-সমালোচনায়ও ঘুরে ফিরেই জামায়াতে ইসলামীর নামটি সামনে উঠে আসছে। দলটির নেতাদের দাবি- জামায়েত ইসলামী শত প্রতিকূল পরিবেশেও দলের সাংগঠনিক কাযক্রম অব্যাহত রেখেছে। একই সঙ্গে সংগঠনকে আরো শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ ও গতিশীল করতে কাজ অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের সঙ্গে জোটভুক্ত জামায়াতে ইসলামীকে রাখা হলে কী সুবিধা এবং না থাকলে কী অসুবিধা হতে পারে এ নিয়ে একাধিক বৈঠক করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। কিন্তু বৈঠকে জামায়াত ইসলামীকে না রাখার বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। বরং জামায়াতে ইসলামীর মাধ্যমে ইসলামী সমমনা ইসলামিক দল ও ইসলামিক চিন্তাবিদদের সঙ্গে কিভাবে সখ্যতা গড়ে তোলা যায় সেই বিয়ষটিতে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্যদেরকে জামায়াত ইসলামীর সার্বিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের উদ্যোগ নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
দুটি কমিটি গঠন করেছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। একটি কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাজ হচ্ছে সরকারবিরোধী দেশের সকল (নিববিন্ধত-অনবিন্ধিত) রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা। আরেকটি অংশের কাজ জোটভুক্ত ২০ দলীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা। যার উপর ভিত্তি করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির পরবর্তী বৈঠকে বাম, ডান ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে দলীয় প্রতিশ্রুতি তুলে ধরবে দলটির নেতারা। এছাড়া অতীতের বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে।
বৈঠক সূত্র মতে- বিএনপি এই মুহুর্তে সরকার বিরোধী দেশের সকল রাজনৈতিক দল (নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত) গুলোর সঙ্গে আলোচনার পথে হাটঁবে। সেক্ষেত্রে ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জোটকে পাশে রেখে প্রয়োজনে কিছুটা নিষ্ক্রিয় করে হলেও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে পাশে চাইবে বিএনপি। যারা যারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিবে তারাই হবে বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামের সহযোদ্ধা কিংবা জোটভুক্ত রাজনৈতিক দল। সেক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী যদি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে অবদান রাখে, তখন হয়তো তাদের বিষয়টি নিয়ে খুব একটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না বিএনপি নেতৃত্বকে। তাছাড়া এক সঙ্গে চলতে শুরু হলে অনেক কিছু উঠে আসবে, পরিস্থিতিই বলে দিবে যুগপৎ আন্দোলনে কোন কোন রাজনৈতিক দল এক প্ল্যাটফর্মে থাকবে। তাই তড়িঘড়ি করে এই মুহুর্তে জামায়াত ইসলামীকে জোট ত্যাগের কথা বলার প্রশ্নই উঠছে না। একইসঙ্গে বৃহত্তর ঐক্যে গঠন প্রক্রিয়ার শুরুতে জামায়াত ইস্যুটিকে নিয়ে সময়ক্ষেপণ অপ্রাসঙ্গিক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের একজন প্রভাবশালী নেতা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ’২০ দলীয় জোট মূলত দুই দলের জোট। একটি বিএনপি অপরটি জামায়াতে ইসলামী। দুটি দলের রয়েছে ভোট, জনসমর্থন, সমর্থক। জোটভুক্ত ২০ দলের অন্য রাজনৈতিক দলগুলো হচ্ছে অনেকটাই কাগজে বাঘ।’
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বর্তমান সম্পর্ক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘একটি পরিবারের অভিভাবকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলে পরিবারটির অন্য সকল সদস্যদের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক খুব একটা হয় না। তেমনি জোট প্রধান খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে অনুপস্থিতিতে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক দৃশ্যত দূরত্ব মনে হতে পারে তবে কার্যত পক্ষে তা নয়। সম্পর্কের ধরণের ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য থাকতে পারে, সেটাও কৌশলগত। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক মতাদর্শে সম্পর্ক আগের মতোই। ফলে জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা আসছে কিভাবে? বরং আমরা জোট ছাড়তে চাইলেও বিএনপি আমাদেরকে জোট থেকে ছাড়তে চাইবে না। রাজপথ আন্দোলন-সংগ্রামে জামায়াত ইসলামী তার সক্ষমতার পরিচয় দিয়েই বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সাময়িক সম্পর্ক স্থাপনে কোনো রাজনৈতিক দল বা কারও কথায় জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি জোট সম্পর্ক ত্যাগ করবে, এতো বড় ভুল সিদ্ধান্ত নেবে এটা ভাবনার কিছু নাই। জামায়াত ইস্যুতে আলোচনায় যা উঠে আসে তা খন্ডিত শব্দচয়ন তাছাড়া কিছু নয়।’
দলটির কর্মপরিষদ সদস্য বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিএনপি যেভাবে নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে তেমনিভাবে জামায়াতে ইসলামীও হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ে বেশি হচ্ছে জামায়াতের ওপর। কারণ ভোটের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনরা বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে চিড় ধরাতে সক্ষম হচ্ছে না। একদিকে সরকারের চাপ অন্যদিকে রাজনৈতিক কৌশল এই দু'য়ে জামায়াতের রাজনীতি চলমান। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ঐক্যবদ্ধ জামায়াতের রাজনীতির বয়স ৫০।
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে এমন বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘জামায়াত ইসলামী নিষিদ্ধ কোনো রাজনৈতিক দল নয় যে তাদের সঙ্গে উঠা-বসা, আলাপ-আলোচনা করা যাবে না। বিএনপি যদি জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দিয়ে দেয় সেক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে জামায়াতকে পাশে টেনে নিবে না এর কোনো নিশ্চয়তা আছে কী? রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই, শঙ্কা তো থাকেই। অতীতে তো ক্ষমতাসীনরা জামায়াত কে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় যুগপৎ আন্দোলন করেছে, তখন কী জামায়াত ভালো ছিল? এখন বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ায় তারা দোষী হয়ে গেল বিষয়টা এমন নয় কী?
তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মুখরোচক আলোচনা নতুন কিছু নয়। তারা সব সময় জনদৃষ্টি বিভ্রান্ত করতে একেক সময় একেক ধরণের মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়। একাদশ নির্বাচনের পূর্বে বিএনপি যখন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছিল তেমনি দলটি এখন বৃহত্তর ঐক্য গঠনে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে তখন ক্ষমতাসীনরা আবারো বিএনপি-জামায়াত প্রসঙ্গে নানা ধরণের আলোচনায় জোট ত্যাগ, জোট গঠনে জামায়াত ইসলামী প্রধান অন্তরায় এমন অবান্তর ইস্যুর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।
এদিকে বিএনপির তৃণমূল নেতাদের ভাষ্য- সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা প্রতিনিয়ত রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে বক্তব্য অব্যাহত রেখেছে। বিএনপিকে দুর্বল করতেই সরকারি দল বিএনপি ও জামায়াতকে নিয়ে নানা অপপ্রচার করছে- যাতে বিএনপি-জামায়াত ঐক্যে ফাটল ধরানো যায়। ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত যেহেতু একটি ফ্যাক্ট; সেহেতু বিএনপি জোট থেকে জামায়াতকে বের করতে পারলে বিএনপির ভোট ব্যাংক দুর্বল করা যাবে। পাশাপাশি জামায়াতকে সরকারি দলের বগলদাবা করা সহজ হবে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যদি জামায়াতকে কাছে টানতে না-ও পারে ২০ দল থেকে জামায়াতকে আলাদা করতে পারাও তাদের বড় সাফল্য বলে ধরা হবে।
এএস