যুবদলে অনিশ্চিয়তা
পূর্ণাঙ্গ নাকি নতুন কমিটি
রাজপথ আন্দোলন-সংগ্রামের ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পরিবর্তে ‘মাইম্যান’ বলয় তৈরিতে সময় অতিবাহিত করছে যুবদল। সংগঠন গোছাতে নেতৃত্ব নির্বাচন সংগঠনটির ‘পকেট’ কমিটিতে পরিণত। আঞ্চলিকতার ‘ইজম’ তৈরিতে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক উভয় নেতা যতটা সক্রিয় সংগঠনের কার্যক্রম উত্তোরণে ততটাই নিষ্ক্রিয়। কেন্দ্রীয় কমিটি কবে কখন পূর্ণাঙ্গ হবে নাকি নতুন কমিটি হবে সে ব্যাপারে কিছুই জানেন না সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্ব। তাদের ভাষ্য-মাঠে কমিটি গঠন ঘিরে আলোচনা আছে, কিন্তু বিএনপির হাইকমান্ড থেকে এখনো সুনিদিষ্ট কোনো বার্তা নেই। তাই কমিটি হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, যুবদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে রাজী নয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। সেজন্য সাবেক ছাত্র-নেতাদের অগ্রাধিকার দিয়ে যোগ্য, ত্যাগীদের সমন্বয় করে যুবদলের কমিটিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সংগঠনটির স্বার্থে সভাপতি সাইফুল আলম নিরব ও সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুকে বাদ দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তও নেওয়া হতে পারে।
২০১৭ সালে ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার নির্দেশনায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি সাইফুল আলম নিরবকে সভাপতি ও সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করে (০৩) বছরের জন্য ‘সুপার-ফাইভ’ কমিটির অনুমোদন হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন সিনিয়র সহ-সভাপতি মোর্ত্তাজুল করিম বাদরু, সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন, সাংগঠনিক সম্পাদক মামুন হাসান।
এদিকে যুবদলের বর্তমান কমিটির নেতারা নির্ধারিত তিন বছরের জায়গায় পাঁচ বছর অতিক্রম করছেন। কিন্তু কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার একমাস পূর্বে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ২৭১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি দলীয় ফোরামে জমা দেন। কিন্তু যাচাই-বাছাই করে কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০২০ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি ১১টি সাংগঠনিক টিম গঠন করেছে। তবে পূর্ণাঙ্গ কমিটির মুখ দেখেনি যুবদল।
অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রদলের সভাপতি থাকাবস্থায় গড়ে তোলা ‘নিজস্ব বলয়’ থেকে ছাত্র-নেতাদের যুবদলে নিয়ে আসতে চাচ্ছেন টুকু। তিনি বড় ভাই আব্দুস সালাম পিন্টুর রাজনৈতিক অর্জনকে পুঁজি বানিয়ে পদ ধরে রেখেছেন। আর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক থাকাবস্থায় যে ‘নিজস্ব বলয়’ গড়ে তুলে ছিল তাদেরকে কমিটিতে নিয়ে আসতে চাচ্ছেন নিবর। যদিও ইতোমধ্যে আংশিক কমিটিতে তার বলয়ের অধিকাংশ নেতাদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। তারপরও তিনি সভাপতির পদ ধরে রাখতে চাচ্ছেন পূর্ণাঙ্গ কমিটি। দলে তার রাজনীতির মূলশক্তি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে ঘনিষ্টসম্পর্কতা। অপরদিকে টুকু সভাপতির পদে যেতে চাচ্ছেন নতুন কমিটি। পূর্ণাঙ্গ ও নতুন কমিটি এই দুইয়ে আটকে রয়েছে যুবদলের ভবিষ্যত নেতৃত্ব। আর কমিটি গঠন বিলম্ব হওয়ায় দিনদিন বাণিজ্যিক দোকান হয়ে উঠছে যুবদল।
যুবদলের সভাপতি সাইফুল আলম নিরব ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘কমিটি পূর্ণাঙ্গ হবে নাকি নতুন করে কমিটি গঠন করা হবে সেই সিদ্ধান্ত বিএনপির হাইকামন্ড নিবেন। আমরা সাংগঠনিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি, তাই যে কোনো সময় কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই তারপরও আমরা সরকারের নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখে থেকে প্রায় সকল জেলা কমিটি এবং উপজেলা পর্যায়ে ৮০% কমিটির কার্যক্রম সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছি। আশা করছি খুব দ্রুত যুবদল তাদের কমিটি পাবে।’
বিএনপির একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে- ‘যুবদলের কমিটিকে নিয়ে দুই কৌশলে এগুচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। একদিকে নিবরকে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে যাওয়া, টুকুকে সভাপতি পদে নিয়ে আসা। অন্যদিকে নিরব-টুকুকে সরিয়ে যুবদল থেকেই যুবদলের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত করা। সাবেক ছাত্র-নেতাদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা। সেক্ষেত্রে এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন, নুরুল ইসলাম নয়ন, মামুন হাসান এদের মধ্যে থেকে সভাপতি এবং ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান বা আকরামুল হাসান মিন্টুকে সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়ে আসা হতে পারে। তবে পূর্ণাঙ্গ কমিটির সম্ভাবনা যেমন আছে তেমনি আছে নতুন কমিটির সম্ভাবনা। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন তারেক রহমান। সেই লক্ষ্যে তিনি যুবদলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মতামত নিচ্ছেন। আশা করছি স্বল্পসময়ের মধ্যে যুবদলের কমিটি নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চিয়তার অবসান হবে।
যুবদলের দফতর সম্পাদক কামরুজ্জামান দুলাল ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেকদিন হলো। কমিটি গঠন নিয়ে একবার শুনি পূর্ণাঙ্গ হবে, আবার শুনি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি হবে। বিচ্ছিন্নভাবে এ সব শোনা যায় কমিটি গঠন হবে। আসলে এর কোনো ভিত্তি নেই। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যখন চাইবেন তখন কমিটি হবে সেটা যে কমিটিই ঘোষণা করা হোক।’
তিনি বলেন, ‘রাজনীতি করি সংগঠনের জন্য কাজ করছি। যদি নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয় সেক্ষেত্রে আমি যুবদলের সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী। আশা করছি হাইকমান্ডের মাধ্যমে কাজের মূল্যায়ণ করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিইচ্ছুক যুবদলের একজন সহ-সভাপতি ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘নিরব-টুকু ব্যক্তি স্বার্থে সংগঠন পরিচালনা করছেন। অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকলেও কমিটি গঠনে উভয় নেতার বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাই পূর্ণাঙ্গ নয়, নতুন কমিটির নেতৃত্ব ছাড়া স্বকীয়তায় ফিরবে না যুবদল। এদের রেখে সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। বুমেরাং হওয়ার শঙ্কা নিয়েও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, ‘নিরব-টুকু ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে অনেকটাই রাজারহালে জীবনযাপন করছেন। তারা পদ ধরে রাখতে যতটা সক্রিয়, ভবিষ্যত নেতৃত্ব তৈরিতে সংগঠনে ততটাই নিষ্ক্রিয়। সংগঠনের অভ্যন্তরে অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করছে, নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে কমিটি হচ্ছে না বলে কর্মীরা দিনদিন বিছিন্ন হয়ে পড়ছেন। প্রতিনিয়ত সংগঠন সাংগঠনিকভাবে ঐক্য হারাচ্ছে।’
যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, কমিটি যতদ্রুত হবে সংগঠন ততদ্রুত সাংগঠনিকভাবে আরো শক্তিশালী হবে। নেতৃত্ব তৈরি করে সংগঠনকে গতিশীল রাখতে কমিটির প্রয়োজনীয়তা আছে। কার্যকর কমিটি একটি সংগঠনকে অধিকার আদায়ে রাজপথ আন্দোলন-সংগ্রামে সঠিক পথ দেখায়, সাফল্য এনে দেয়। পূর্ণাঙ্গ কমিটি নাকি নতুন কমিটি করা হবে সেই সিদ্ধান্ত হাইকমান্ড নিবেন।
তিনি বলেন, ‘পদ প্রত্যাশা সবার থাকে আমারও আছে। যদি সংগঠনে আমার চেয়ে সিনিয়র কাউকে নেতৃত্বে না আনা হয় তাহলে আমি শীর্ষপদ (সভাপতি) প্রত্যাশা করছি।’
যুবদলের নেতৃত্বে যেতে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন যারা
যুবদলের সভাপতি পদে আলোচনায় রয়েছেন মোর্ত্তাজুল করিম বাদরু, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন, নুরুল ইসলাম নয়ন, মামুন হাসান, সাধারণ সম্পাদক পদে যুবদলের দফতর সম্পাদক কামরুজ্জামান দুলাল, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রাজীব আহসান, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান মিন্টু, যুবদল নেতা শরিফ উদ্দিন জুয়েল, সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার, ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি মহিদুল ইসলাম হিরো নাম আলোচনায় রয়েছে।
প্রসঙ্গত, প্রতিষ্ঠার চার দশক পেরিয়ে গেলেও এপর্যন্ত কমিটি হয়েছে মাত্র ৬টি। সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি হয়েছে ৩টি। বাকিগুলো প্রেস রিলিজের মাধ্যমে করা হয়েছে।
এমএইচ/