কারওয়ান বাজারের আতঙ্ক ‘পিচ্চি’ গ্রুপ
সাত-আটজনের একটি দল। বয়স ১৮ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। সবাই মাদকসেবী। রাতের বেলায় তারা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। সড়কের নিরিবিলি অংশে কাউকে পেলেই হামলে পড়ে। মারধর করে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। কেউ ছিনতাইয়ে বাধা দিলে বেড়ে যায় নির্যাতনের মাত্রা। তরুণ অপরাধীদের এই চক্রটির হোতা সুমন হোসেন ওরফে পিচ্চি শুভ।
সম্প্রতি এক রাতে পরপর দু’টি ছিনতাই করে পালানোর পথে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে একাধিক চক্রের অপকর্মের নানা তথ্য। এরমধ্যে রয়েছে মুরগি, সবজি ও মাছ চুরির আলাদা আলাদা চক্র। চক্রের সদস্যরা রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত কারওয়ানবাজার এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশের দাবি, বিভিন্ন সময়ে অন্তত ৪৩ শিশুকে আটক করে সংশোধাগারে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া অপকর্মে যুক্ত আরও একাধিক শিশুকে আটকের চেষ্টা চলছে বলে সংশ্লিষ্ট থানা সূত্রে জানা গেছে।
তেজগাঁও থানার ওসি অপূর্ব হাসান বলেন, সম্প্রতি ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজারের মাঝামাঝি অংশে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন এক সংবাদকর্মী। তার অভিযোগের ভিত্তিতে ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালায় পুলিশ। এর মধ্যে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশ এক ছিনতাইকারী ও চোরাই মোবাইল ফোনের এক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে।
তিনি বলেন, ছিনতাইয়ের জড়িত এসব পথশিশুরা দিনের বেলায় বিভিন্ন ঝুপড়ি ঘরে ঘুমিয়ে থাকে। রাতে তারা বের হয়ে খামারবাড়ি থেকে শুরু করে কারওয়ানবাজার পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। এ ধরনের কাজে জড়িত একাধিক শিশুকে আটক করে সংশোধানাগারে পাঠানো হয়েছে। অপকর্মে যুক্ত আরো একাধিক শিশুর সন্ধান করা হচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, কারওয়ানবাজার কেন্দ্রিক অন্তত শতাধিক পথশিশু বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত। তারা নেশার টাকা জোগাড় করতে এ ধরনের পথে পা দিয়েছে। আবার অনেকের অবিভাবক না থাকার কারনে থাকা ও খাওয়ার টাকা জোগাড় করতে অপরাধে নাম লিখিয়েছেন। আবার অনেকের বাবা না থাকার কারনে মা ও ছোট ভাইবোনের খরচ জোগাতেও খারাপ পথে পা বাড়িয়েছেন।
পুলিশের ভাষ্যমতে, রাতে এসব শিশুরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে কারওয়ানবাজার ফার্মগেট ও খামার বাড়ি এলাকায় অবস্থান নেয়। মাছ-সবজি ও মুরগীর গাড়ি যানজটে পড়লেই চক্রের এক সদস্য লাফিয়ে চলন্ত গাড়িতে উঠে পড়ে। এরপর ধারালো কার্টার দিয়ে সবজির বস্তা কেটে দেয়। এতে সবজি রাস্তায় পড়লেই চক্রের অন্য সদস্যরা তা নিয়ে পালিয়ে যায়। একই ভাবে তারা মাছ ও মুরগির চলন্ত গাড়িতে উঠে পড়ে মালামাল লুট করে চলে যায়। একইভাবে চলন্ত সিএনজি অটোরিক্সার পেছতে উঠে কার্টার দিয়ে সিএনজির প্লাস্টিকের ছাউনি কেটে যাত্রীদের মোবাইল ফোন মূল্যবান মালামাল লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাস অথবা অন্য যানবাহনের জানালা দিয়েও ছো মেরে মোবাইল ও ঘড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। তবে এসব চক্রের বাইরে সরাসরি ছিনতাই করে একটি গ্রুপ। এই গ্রুপের সদস্যরা বেশি ভয়ঙ্কর।
সম্প্রতি ছিনতাইকারীর কবলে পড়া ফিরোজ আহমেদ নামে এক সংবাদকর্মী জানান, পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে রোববার রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি বাসায় ফিরছিলেন। পথে ডেইলি স্টার ভবন সংলগ্ন ফুটওভারব্রিজে ওঠার পর সাত-আটজন তাকে ঘিরে ধরে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে মারধর শুরু করে দুর্বৃত্তরা। তারা ইট দিয়ে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে। একপর্যায়ে তারা ছুরিকাঘাত করতে উদ্যত হলে তিনি প্রাণভিক্ষা চান এবং সঙ্গে থাকা টাকা-মোবাইল ফোন নিয়ে নিতে বলেন। এরপর তার ৪০ হাজার টাকা দামের ফোন, কিছু নগদ টাকা ও পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য কাগজপত্র কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। আহত ফিরোজ তেজগাঁও থানায় গিয়ে বিষয়টি জানান। তার অভিযোগ লিখে নিয়ে পুলিশের একটি দল তাকে সঙ্গে নিয়েই ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারে বের হয়।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার এসআই আমিনুল ইসলাম বলেন, ওই রাতে আমি হাতিরঝিল সংলগ্ন রেইনবো ক্রসিং এলাকায় টহল দায়িত্বে ছিলাম। সেখানে চার তরুণের একটি দল দাঁড়িয়েছিল। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় আমি পুলিশ ভ্যান থেকে নেমে এগিয়ে যাই। আমাকে দেখে তারা একেকজন একেক দিকে দৌঁড় দেয়। শেষপর্যন্ত ধাওয়া করে একজনকে ধরে ফেলি। প্রথমে সে কিছুই স্বীকার করেনি। তবে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে, সে কারওয়ান বাজার কেন্দ্রিক ছিনতাইকারী চক্রের হোতা পিচ্চি শুভ। তার কাছে লুণ্ঠিত একটি মোবাইল ফোন পাওয়া যায়।
পরে জানা যায়, সেটি এক সংবাদকর্মীর। এটি ছিনতাইয়ের আগে ওই রাতেই ৩৫ হাজার টাকা দামের আরেকটি মোবাইল ফোন ছিনতাই করে তারা। সেটি কারওয়ান বাজারের একটি দোকানে বিক্রি করে পাঁচ হাজার টাকা পায়। সেই টাকা নিয়ে তারা মগবাজার এলাকার একটি বারে গিয়ে মদ পান করে। এরপর আবার ছিনতাইয়ে নামে। দ্বিতীয় দফায় তারা সংবাদকর্মীর ফোনটি ছিনতাই করে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার চোরাই মোবাইল ফোনের ক্রেতা সাইফুদ্দিনকে কারওয়ান বাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেখানে তার মোবাইল ফোন সার্ভিসিংয়ের দোকান রয়েছে। সে এই চক্রটিকে চুরি-ছিনতাইয়ে উৎসাহ দেয়, যাতে সস্তায় দামি ফোন কিনতে পারে। ঘটনাস্থল তেজগাঁও থানার আওতাধীন হওয়ায় পরে তাকে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হয় বলেও জানান এসআই আমিনুল ইসলাম।
তেজগাঁও থানার এসআই সুমন চন্দ্র শীল বলেন, চোরাই মোবাইল ফোন কেনাবেচার অভিযোগে সাইফুদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত মঙ্গলবার তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার পিচ্চি শুভ ছোটবেলা থেকেই নানারকম অপরাধে জড়িত। তার মা কারওয়ান বাজারে ট্রাক থেকে পড়ে যাওয়া সবজি কুড়িয়ে বিক্রি করেন। অনেক আগেই তার মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়েছে। এই চক্রের অপর সদস্যরাও ভাসমান। তারা ফুটপাত বা ফুটওভারব্রিজে থাকে। মূলত মাদকের টাকা যোগাতেই তারা ছিনতাই করে।
এনএইচ/