মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের শীর্ষে পদ্মা সেতু
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠন করেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে বড় বড় ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছে। যা ফাস্ট-ট্র্যাক (মেগা প্রকল্প) নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তদারকি করা হচ্ছে। দ্রুত বাস্তবায়নে প্রতি অর্থবছর অনেক অর্থও বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্প অধিকাংশ বর্তমানে দৃশ্যমান।
বাস্তবায়নের শীর্ষে পদ্মা সেতু। ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে ৮৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। এরপরই পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ৮৩ শতাংশ। তারপর এগিয়ে রয়েছে ঢাকা মেট্রো রেল-৬ এর কাজ। প্রায় শেষের পথে, ডিসেম্বর পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে ৭৪ শতাংশ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিশ্বব্যাংককে জবাব দিয়ে শীর্ষে পদ্মা সেতু: বাংলাদেশের উন্নয়ন কাজে এক সময়ে বিদেশি অর্থের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণের আগে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অপবাদ সরকারকে চরমভাবে ক্ষত-বিক্ষত করে। কারণ, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অজুহাতে মুখ ফিরিয়ে নিলে এডিবিসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাও সরে যায়। তারা মুখ ফিরিয়ে নিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ নেন, যেভাবেই হোক নিজস্ব অর্থেই করা হবে এটা। এর কাজও শুরু হয় ২০১৪ সালে। সাত বছরের ব্যবধানে সবাইকে তাক লাগিয়ে বর্তমানে দৃশ্যমান হয়ে গেছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ডিসেম্বর পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৮৯ দশমিক ৫০ শতাংশ।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটির নির্মাণে ২০০৭ সালের আগস্টে সরকার অনুমোদন দেয়। তখন প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। বিভিন্ন কারণে এর ভৌত কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। সাত বছরের ব্যবধানে সবাইকে তাক লাগিয়ে বর্তমানে দৃশ্যমান হয়ে গেছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। তবে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৬ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা বা ৮৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।
বাস্তবায়নকাল ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে কয়েক দফা সংশোধন করে বাড়ানো হয়েছে। গত জুনে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু আবারও এক বছর সময় বাড়ানো হয়েছে। আগামী জুনে এটি সবার জন্য উন্মুক্ত হবে। কাজকে এগিয়ে নিতে চলতি অর্থবছরে বাজেটে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
পায়রা গভীর বন্দর: বাংলাদেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর পায়রা গভীর বন্দরের ভৌত কাজের অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৮৩ শতাংশ। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় অবস্থিত বন্দরটির কাজ ২০১৫ সালে শুরু হয়ে ২০২২ সালের জুনে শেষ হবে। ডিসেম্বর পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে তিন হাজার ২৬৬ কোটি টাকা বা ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কাজকে দ্রুত এগিয়ে নিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৭০ কোটি টাকা।
মেট্রোরেল-৬: হাটিহাটি পা পা করে নতুন প্রযুক্তির মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজও এগিয়ে চলছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৬ এর নির্মাণ কাজের সার্বিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৭৪ দশমিক ০৪ শতাংশ। আর আর্থিক অগ্রগতি প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বা ৭৭ দশমিক ২৬ শতাংশ। প্রথম পর্যায়ে চালুর জন্য উত্তরা হতে আগারগাঁও পর্যন্ত ধরা হয়েছে। তবে আগারগাঁও হতে মতিঝিল অংশের কাজও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসনকে আমলে নিয়ে মতিঝিল থেকে কমলাপুর অংশে ভূমি অধিগ্রহণ ও ডিটেইল ডিজাইনসহ প্রাথমিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুনে বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রায় সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি আগামী ডিসেম্বরে প্রথম অংশ চালু হবে স্বপ্নের এ প্রকল্প। কাজ শেষ করতে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তিন হাজার ৪৭০ কোটি টাকা।
রামপাল মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট: আরেকটি ফাস্ট-ট্র্যাক প্রকল্প হচ্ছে-রামপাল মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট। ডিসেম্বর পর্যন্ত এর ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৭৪ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ১১ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা প্রায় ৭৪ শতাংশ। প্রকল্পটির আওতায় বাগেরহাটের রামপালে একটি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে।
মাতারবাড়ি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র: মহেশখালীর মাতারবাড়িতে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের আরেকটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকার প্রকল্পটির মোট ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৫২ দশমিক ২৯ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ১৯ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে এ প্রকল্প শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। যা ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা।
দোহাজারী থেকে কক্সবাজার-রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটির ডিসেম্বর পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে ৬৬ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ছয় হাজার ২৩০ কোটি টাকা বা প্রায় ৩৫ শতাংশ। চীনের ঋণে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০১০ সালে জুলাই শুরু হয়েছে। সংশোধন করে সময় বাড়িয়ে তা শেষ হবে ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পটি সম্পন্ন করার কথা রয়েছে। কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে চলতি অর্থবছরে বাজেটে দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প: এটি ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়েছে। ২০২২ সালের জুনে তা শেষ করতে বলা হয়েছে। ৩৯ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রতি অর্থবছরে বাজেটে বেশি করে বরাদ্দও দিচ্ছে সরকার। এবারও তিন হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে ৫০ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ২০ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা বা ৫১ দশমিক ৮২ শতাংশ।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: রাশিয়া সহায়তায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজের ২০১৬ সালের জুলাইতে শুরু হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৩ দশমিক ১২ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। আর আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৪৬ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা বা ৪১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। সরকার চলতি অর্থবছরে এডিপিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১৫ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এক লাখ ১৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৫ সালে শেষ হবে।
কর্ণফুলি ট্যানেলের কাজও এগিয়ে যাচ্ছে: ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কর্ণফুলি ট্যানেলের কাজও এগিয়ে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করে ২০১৫ সালের নভেম্বরে শুরু করেছে। শেষ হবে ২২ সালের ডিসেম্বরে। ২০১৯ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি খনন কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এটি বাংলাদেশ ও চীন সরকারের (জি টু জি) যৌথ অর্থায়নে সেতু কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হচ্ছে। কাজ দ্রুত শেষ করতে ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করছে চীন সরকার।
জেডএ/এমএসপি