সেই মাইক্রোফোন সযত্নে রেখেছে কল-রেডী, বঙ্গবন্ধু পরিবার চাইলেই হস্তান্তর
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বাঙালির নানান শিকল থেকে মুক্তির জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর এই মুক্তির আওয়াজ সারা বিশ্বে যে সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে ছড়িয়েছিল সেই মাইক্রোফোনের নাম কল-রেডি। কল-রেডীর নাম শোনেননি এমন লোক এই দেশে খুব কমই আছে।
বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানের সেই ১৮ মিনিটের ভাষণ জাগ্রত করেছিল পুরো বাঙালিকে। সেই ভাষণে অনুপ্রণিত হয়েই বাঙালি অংশ নেয় মুক্তিযুদ্ধে। সেই বিখ্যাত ভাষণ স্থান পেয়েছে ইউনেস্কোর সেরা সব ঐতিহ্যের তালিকায়। ১৯৭১ সালের সাতই মার্চের অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়েছিল কল-রেডী সাউন্ড সিস্টেম।
শুধুমাত্র সাতই মার্চ নয় বাঙালির বিভিন্ন সংগ্রামে জড়িয়ে আছে কল-রেডীর নাম। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৯ এর গণভ্যুথান কিংবা ৭০-এর নির্বাচন, সব নামের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট সেই কল-রেডী। বর্তমানে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মিটিং, মিছিল কিংবা জনসভাতেও দেখা পাওয়া যায় এই সাইন্ড সিস্টেমের। কল-রেডীর মাইকে ভাষণ দিয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিদেশিদের মধ্যে অন্যতম নেলসন ম্যান্ডেলা, ইন্দিরা গান্ধী, প্রণব মুখার্জি, বিল ক্লিনটন প্রমুখ।
কল-রেডীর ইতিহাস থেকে জানা যায়, পুরান ঢাকায় ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেন দুই সহোদর হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ। বাবার ইচ্ছানুসারে ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসা করার কথা থাকলেও দুই ভাই অনীহা প্রকাশ করেন এই ব্যবসায়। কারণ, পুরান ঢাকায় অনেক কাপড়ের দোকান তাই ভাবেন অন্য ব্যবসা করবেন। সিদ্ধান্ত নেন আলোকসজ্জার ব্যবসা করবেন। কারণ, পুরান ঢাকার মানুষ সাজ সজ্জা বেশ পছন্দ করেন। ১৯৪৮ সালে শুরু করেন ‘আরজু লাইটি হাউজ’ দোকানের প্রথম ক্রেতা ছিলেন স্থানীয় শ্যামলকান্তি বড়াল।
তিনি ৩ টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন মেয়ের বিয়ের জন্য। একই সময়ে আশেপাশে এই ধরনের দোকান গড়ে উঠলে দুই ভাই মিলে আলোকসজ্জার পাশে শুরু করেন সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবসা। শুরুতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গ্রামোফোন ভাড়া দেওয়ার কাজ করতেন এরপর ভারত থেকে হ্যান্ড মাইক এনে ব্যবসা শুরু করেন। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চীন, তাইওয়ান, জাপানসহ অন্যান্য দেশ থেকে মাইক আনতে শুরু করেন৷
কল-রেডীর নাম কল-রেডী রাখার কারণ হলো যারা মাইক বা সাইন্ডসিস্টেম ভাড়া করবেন তারা চাইলেই অর্থাৎ মাইকের কথা বললেই তারা রেডি থাকা অর্থাৎ কল করলেই রেডী। এর জন্যই নাম রাখা হয়েছে কল-রেডী।
বর্তমানে কল-রেডীর দেখাশোনা করছেন সাগর ঘোষ, রানা ঘোষ, বিশ্বনাথ ঘোষ ও শিবনাথ ঘোষ। তারা চার সহোদর। প্রতিষ্ঠানেই দেখা সাগর ঘোষের সঙ্গে। সাগর ঘোষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেননি। তবে বাবা-জেঠার মুখে অনেক গল্প শুনেছেন।
বঙ্গবন্ধু হরিপদকে স্নেহ করে ‘পাগলা’ ডাকতেন-বলে জানান সাগর ঘোষ। পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিং কিংবা তার আশপাশে এলে বঙ্গবন্ধু হরিপদের খোঁজখবর নিতেন বলে ছেলে সাগর ঘোষকে জানিয়েছেন তার বাবা।
৭ মার্চ ১৯৭১ সালের ভাষণের আগের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাগর ঘোষ জানান, ৭ মার্চের পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির বাসভবনে হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষকে ডেকে নেন। সে সময়কার রেসকোর্স ময়দানে মাইক লাগাতে নির্দেশনা দেন। কত মাইক লাগাবেন এই সংখ্যা জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু জানান যত পারো তত। এরপর একশোর অধিক মাইক লাগানো হয় সারা মাঠ জুড়ে।
সমাবেশের কয়েকদিন আগে থেকেই কাজ শুরু করেন তারা। পাকিস্তান সরকারের ভয় উপেক্ষা করে চলতে থাকে কাজ। রাতের আধারে মাইক লাগানো হয়। অনেক মাইক লুকিয়ে রাখা হয় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। ববঙ্গবন্ধু যে মাইক্রোফোনে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটি এখনো সযত্নে আগলে রেখেছে কল-রেডী কর্তৃপক্ষ। বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ চাইলেই সেসব হস্তান্তর করবেন তারা।
এমএমএ/