কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় বাড়ছে বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ড
একের পর এক অগ্নিকাণ্ড আর বিস্ফোরণের ঘটনা নগরবাসীকে শঙ্কা আর আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এসি বিস্ফোরণ, বৈদ্যুতিক শট সার্কিট, গ্যাসের লাইনে জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণসহ নানা কারণে নগরীর ভবনগুলোতে বিস্ফোরণ বেড়েই চলেছে। নিয়ম না মানা, কর্তৃপক্ষগুলোর উদাসীনতা ও সচেতনতার অভাবের কারণেই মূলত এসব বিস্ফোরণ ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী রাজধানী ঢাকায় ৬৫ থেকে ৭৫ হাজার ভবন অগ্নিঝুঁকিসহ নানামুখী ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবন নির্মাণে নীতিমালা না মানা এবং নিম্নমানের সরঞ্জাম ব্যবহার করার কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা। এ ছাড়া, বৈদ্যুতিক লাইন, গ্যাস পাইপ লাইন ও সুয়ারেজ লাইনের সংস্কার না করার কারণেও ঝুঁকিতে রয়েছে অধিকাংশ ভবন।
শীতকালে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) বন্ধ থাকে। গরমে এসি চালু করতে গেলে সার্ভিসিং করা দরকার। কারণ, গ্যাস জমে যায়। কিন্তু কয়টা টাকা খরচ হবে বলে অনেকেই এসির সার্ভিসিং করান না। বিস্ফোরণের এটাও একটা কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
অনেকেই ভবন নির্মাণের সময় কিছু টাকা বাঁচাতে নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করেন। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি গুলশানের একটি আবাসিক বহুতল ভবনে আগুন লাগার কারণ ছিল বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট। এ বিষয়ে সতর্ক হওয়ার দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভবন নির্মাণে নীতিমালা মানানোর দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। কিন্তু রাজউকের চোখের সামনেই বড় বড় ভবন নির্মাণ হলেও তদারকি নাই প্রতিষ্ঠানটির। এই শহরে শুধু তালিকাভূক্ত ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবনই আছে ১৮১৮টি। এগুলোতে কোন অগ্নিনিরাপত্তা নাই। এ ছাড়া, রাজউকের সাত হাজার ভবনের তালিকা আছে যেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। কিন্তু গত দেড় দশক ধরে সেগুলো ভাঙা যায়নি।
গ্যাস পাইপলাইন ও সুয়ারেজ লাইনে জমে থাকা গ্যাসেও ঘটছে দুর্ঘটনা। নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের একটি বড় উদাহরণ। ওই ঘটনায় ২৪ ব্যক্তি নিহত হন এবং আহত হন শতাধিক। ওই দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ জানিয়েছিল, গ্যাস পাইপলাইন লিকেজের ফলে বিস্ফোরণ হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ছিল উদাসীন। পরে একটি মামলা হয়েছে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দিয়েছে পুলিশ। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন।
২০২১ সালের এপ্রিলে ঘটে ভয়াবহ ‘মগবাজার বিস্ফোরণ’। এই ঘটনায়ও ১২ জন নিহত হন এবং আহত হন শতাধিক। এই বিস্ফোরণে আশেপাশের অন্তত আরও পাঁচটি ভবন এবং দুটি যাত্রীবাহী বাসেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা তখন জানান, ভবনের কোথাও গ্যাস জমে এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
এরপর একে একে ছোটবড় অনেকগুলো ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। রবিবার (৫ মার্চ) রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় একটি বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এর কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামে একটি ভবনে বিস্ফোরণ হয়। তারও আগে ময়মনসিংহে এমন ঘটনা ঘটে।
বর্তমানে তিতাসের গ্যাস সঙ্কটের কারণে সিলিন্ডার ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু সিলিন্ডার ব্যবহারকারীরা জানেনই যে সিলিন্ডারের একটা মেয়াদ থাকে। তারপর ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে এমন অসচেতনতার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে।
জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ভবন নির্মাণে নীতিমালা মানা হচ্ছে না। নির্মাণে প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের দিকে নজর দেওয়া হয় না।
তিনি আরও বলেন, ঢাকার গ্যাসলাইনগুলো জরাজীর্ণ। এর সঙ্গে রয়েছে অপরিকল্পিত খোঁড়াখুড়ি। এই খোঁড়াখুড়ির সময় মাটির নিচের লাইনগুলো প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে লিকেজ তৈরি হয় এবং গ্যাস বের হয়। কর্তৃপক্ষগুলো যেমন কোনো তদারকি করছে না, তেমনি ঝুকি রোধে কোনো পদক্ষেপও নিচ্ছে না।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সভাপতি আবু নাসের খান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ভবন নির্মাণে নীতিমালা মেনে চলা, মানসম্মত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার, দক্ষ টেকনিশিয়ান দিয়ে বিদ্যুতের ওয়্যারিংয়ের কাজ করাতে হবে।
গ্যাস লিকেজ বন্ধে তিতাসকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দুর্ঘটনা রোধে বিএসটিআই, রাজউক, সিটি করপোরেশন, বিস্ফোরক অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন।
তদন্তকারী সংস্থার দাবি, এই শহরের অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত এসব আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস ও বৈদ্যুতিক সংযোগ। নেই কোনো সংস্কারের কাজ। নানা ধরনের গাফিলতির কারণে একের পর এক ঘটছে বহুমুখী দুর্ঘটনা। আর এসব দূর্ঘটনায় বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা।
এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাতে ৬৫ হাজার থেকে ৭৫ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আছে।
ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তারাও জানান, ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলকায় প্রায় ৬৫-৭০ হাজারের বেশি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বলে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে। এসব ভবনে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ইতিমধ্যে সবাইকে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সূত্র বলছে, নিয়ম না মেনে ভবন তৈরি, অনিরাপদ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ, ত্রুটিপূর্ণ সংযোগ মেরামত না করাসহ ভবনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটে যাওয়ার দুর্ঘটনাগুলোর মূল কারণ।
নগরপরিকল্পনা ও পরিবেশবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকা এখন খুব বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। তা ছাড়া, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের লাইনের নকশাও নেই। তারা জানেও না কোথায় কোথায় গ্যাস লাইন রয়েছে! আবার সেগুলোর সংস্কারও করা হচ্ছে না। যদি সেগুলো বিস্ফোরণ হয়, তবে বিপুল পরিমাণ ক্ষতির মুখে পড়বে বাংলাদেশের মানুষ।
তিনি বলেন, ‘যেভাবে ভবনে আগুন ও বিস্ফোরণ ঘটনা ঘটছে তাতে বলা যায় ঢাকা শহর এখন বিস্ফোরণ ও বোমার শহরে পরিণত হতে যাচ্ছে।’
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মইন উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের ঢাকা শহরে প্রতিবছর গড়ে ৯০ হাজারের বেশি ভবন তৈরি হচ্ছে। ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বছরে গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার ভবনের অনুমোদন দেয়। তাহলে বাকি ভবন কীভাবে হচ্ছে? তাই যারা ভবন তৈরি করছেন, তাদের অনুরোধ করে বলতে চাই, বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুযায়ী আপনারা ভবন তৈরি করবেন।
তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের লিস্ট করে এবং সাধারণ মানুষকে এসব বিষয়ে সতর্ক করেছি।’
এনএইচবি/এমএমএ/